ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত ? জানুন বিস্তারিত

mybdhelp.com-ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত
প্রতীকী ছবি

 ফারাক্কা বাঁধ কোথায় অবস্থিত, ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলায়, গঙ্গা নদীর উপরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সীমান্ত কাছাকাছি, যা গঙ্গা নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখতে নির্মিত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের মূল উদ্দেশ্য ছিল নদী প্রবাহকে নির্দিষ্টভাবে পরিচালনা করা, যাতে হুগলি নদীর মাধ্যমে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা যায়।

১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকে কলকাতার বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই বাঁধের মাধ্যমে কলকাতার বন্দরটিতে জলযান চলাচল করতে সহায়তা করে এবং অর্থনৈতিক বাণিজ্য শক্তিশালী করে। একই সময়ে, বাঁধটির অবস্থিতি এবং এর কার্যকারিতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান ও নির্মাণ ইতিহাস

ফারাক্কা বাঁধের অবস্থিতি:
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্যের মালদহমুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে ফারাক্কা বাঁধটি অবস্থিত। এই বাঁধটি গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত, যেখানে হুগলি নদী দিয়ে কলকাতার বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা হয়। বাঁধটি বাংলাদেশের সীমান্ত কাছাকাছি হওয়ার কারণে, গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই বিতর্ক রয়েছে।

বাঁধটির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং এর মাধ্যমে গঙ্গার পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা ভারতের কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কলকাতা বন্দরের কার্যক্রম সচল রাখে।

নির্মাণ ইতিহাস:
ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে এবং ১৯৭৫ সালে এটি সম্পূর্ণভাবে চালু হয়। এটি ভারত সরকারের প্রকল্পের অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণের সময়, বাংলাদেশের পদ্মা নদী এর প্রভাবিত ছিল এবং এই কারণে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ফারাক্কা বাঁধের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা

কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা:
ফারাক্কা বাঁধের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা, যা ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। কলকাতা বন্দর জলযান চালানোর জন্য হুগলি নদীর পানির গভীরতা যথাযথ রাখতে বাঁধটি গঙ্গার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে, কলকাতার বন্দরটির মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও উন্নত হয়, যা ভারতের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সেচ সুবিধা:
ফারাক্কা বাঁধটি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অঞ্চলে সেচ সুবিধা প্রদান করে। বাঁধটি গঙ্গার পানি বণ্টন করে সেচ খালের মাধ্যমে কৃষকদের ফসল চাষে সাহায্য করে। পানিসেচ ব্যবস্থা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেখানে বর্ষার উপর নির্ভরশীলতা কম। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উৎপাদনপণ্য উৎপাদনে সুবিধা পাওয়া গেছে।

জলবিদ্যুৎ উৎপাদন:
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ফারাক্কা বাঁধ ব্যবহৃত হয়, যা পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধটির মাধ্যমে প্রাপ্ত জলবিদ্যুৎ ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি এলেকট্রিসিটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সহায়তা করে।

ফারাক্কা বাঁধের গঠন ও পরিকাঠামো

ফারাক্কা বাঁধের গঠন:
বাঁধটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২,২৪০ মিটার (২.২৪ কিলোমিটার) এবং এতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে, যা গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বাঁধটির গেটগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি ব্যবহৃত হয় পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং হুগলি নদীর জলস্তর বজায় রাখার জন্য। বাঁধটি মূলত একটি কংক্রিটের স্লু ফেজ (sluice gate) বাঁধ, যা নদীটির পানির প্রবাহের দিকে লক্ষ্য রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।

ফিডার খাল ও খালব্যবস্থা:
ফারাক্কা বাঁধের সাথে সংযুক্ত একটি ফিডার খাল রয়েছে, যা হুগলি নদী পর্যন্ত পানির প্রবাহ সরবরাহ করে। এই ফিডার খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং এটি নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে যাতে জলযান চলাচল সহজ হয় এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রভাবিত এলাকাগুলোতে সেচ সুবিধা প্রদান করা যায়।

ফারাক্কা বাঁধের পরিবেশগত প্রভাব

বাংলাদেশে প্রভাব:
ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের পদ্মা নদী ও অন্যান্য নদীগুলোর প্রবাহে বড় প্রভাব ফেলেছে। বাঁধটির কারণে গঙ্গার পানি বাংলাদেশের দিকে যাওয়ার প্রবাহ কমে গেছে, যার ফলে পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়া এবং বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাব স্থানীয় কৃষি, জলাভূমি এবং মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের উপর অত্যন্ত বিরূপ হয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি সংকট দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে পদ্মা নদী এর পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে পানির স্তর কমে যাওয়ায় বিশাল কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নদীভাঙন ও বন্যা:
বাঁধটির কারণে গঙ্গার প্রবাহের পরিবর্তন এবং পানি সঞ্চয়ের জন্য বিভিন্ন নদীভাঙন এবং বন্যা আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা এবং শরীয়তপুর জেলার কিছু অংশে নদীভাঙন এবং বন্যা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এর ফলে, কৃষক ও স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

কৃষি ও মৎস্যজীবীদের উপর প্রভাব:
ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায়, কৃষকরা প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন কমে গেছে। পাশাপাশি, মৎস্যজীবীরা নদীতে মাছ ধরতে অক্ষম হচ্ছেন, কারণ পানি কমে যাওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক বাসস্থান বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

বিশেষত, মৌসুমী ফসল যেমন ধান, পাট ও তামাক উৎপাদনে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মৎস্যজীবীরা আরও বেশি দূরত্বে গিয়ে মাছ ধরতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থানীয় জনগণের জীবিকা:
ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধু কৃষি ও মৎস্যসম্পদই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং বাঁধের প্রভাবে স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও বসবাসও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষত যারা কৃষি, মৎস্য এবং নৌকা চালানোর সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিকভাবে, বাঁধের কার্যক্রমে স্থানীয় সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।

ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ

পানি বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব:
ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণের পর থেকে বাংলাদেশ এবং ভারত এর পানি বণ্টন নিয়ে একাধিক বিরোধে জড়িত হয়েছে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার প্রবাহ কমে যাওয়া এবং পদ্মা নদীর পানি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে পানির অভাব এবং বন্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে, ভারতের পানি ব্যবহারের নীতি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে।

১৯৯৬ সালের পানি চুক্তি:
এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত একে অপরের মধ্যে পানি বণ্টন সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা গঙ্গার পানি ব্যবহারের সঠিক ভাগ-বাটোয়ারা করার লক্ষ্য ছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ থেকে পানির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় এবং বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী তা সরবরাহ করতে বলা হয়। তবে, এই চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে এবং অনেক সময় এটি যথাযথভাবে পালন করা হয় না।

দ্বিপাক্ষিক সমাধান:
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। উভয় দেশ একসাথে নদী ব্যবস্থাপনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাতে ভবিষ্যতে পরিবেশ ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

ফারাক্কা বাঁধের ভবিষ্যত ও সমাধানের পথে পদক্ষেপ

পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ:
ফারাক্কা বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগণ এবং কৃষকদের জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া জরুরি। যদিও কিছু ফারাক্কা বাঁধ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনগণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে আরও কাজ করা দরকার। বাংলাদেশে পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ভারত পুনরায় পানি সংরক্ষণ এবং প্রবাহের জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে।

দ্বিপাক্ষিক সমন্বয়:
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। দুটি দেশই যদি একসাথে এই বাঁধের কার্যকারিতা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে তবে নদীজীবন, কৃষি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সুরক্ষিত থাকবে। দুই দেশের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং নদী গবেষণা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

উপসংহার

ফারাক্কা বাঁধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত, তবে এর প্রভাব কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশ সহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উপর রয়েছে। এই বাঁধটি কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা, সেচ সুবিধা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর কারণে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়া, কৃষি ক্ষতি এবং মৎস্যজীবীদের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যা এবং ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব দ্বিপাক্ষিক আলোচনাসম্পর্ক উন্নয়ন এর মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা যেতে পারে।

প্রধান বিষয়সমূহ:

  • ফারাক্কা বাঁধ ভারতের মালদহমুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত।
  • বাঁধটির প্রধান উদ্দেশ্য কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা, সেচ সুবিধা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন।
  • বাঁধের কারণে বাংলাদেশের পদ্মা নদী এবং প্রাকৃতিক সম্পদ এর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
  • ১৯৯৬ সালের পানি চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সম্ভাব্য সমাধানের পথে।

ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে দুই দেশের উন্নয়ন এবং নদী সংরক্ষণের জন্য ভবিষ্যতে যৌথ উদ্যোগ অপরিহার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top