কবর জিয়ারতের নিয়ম : ইসলামিক দৃষ্টিকোণ, উদ্দেশ্য ও ফজিলত

mybdhelp.com-কবর জিয়ারতের নিয়ম
ছবি: প্রতীকী

কবর জিয়ারতের নিয়ম : কবর জিয়ারত করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা মানুষকে মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি মৃতদের জন্য দোয়া করার একটি সুযোগ এবং জীবিতদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়।

কবর জিয়ারতের মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য অনুপ্রেরণা পায় এবং আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

অনেকেই কবর জিয়ারতের সঠিক নিয়ম, সুন্নত পদ্ধতি ও দোয়া সম্পর্কে জানেন না। তাই এই প্রবন্ধে আমরা কবর জিয়ারতের সঠিক নিয়ম, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর ফজিলত এবং মৃতদের জন্য করণীয় দোয়া ও ইবাদত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কবর জিয়ারতের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

কবর জিয়ারত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা

ইসলামে কবর জিয়ারত করা বৈধ, তবে এটি শিরক বা বিদআত পরিহার করে করতে হবে।

কুরআনে বলা হয়েছে:
“সে ব্যক্তি সফল, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল এবং তার রবের নাম স্মরণ করল ও নামাজ পড়ল। কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে বেশি প্রাধান্য দাও, অথচ আখিরাতই হলো শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী।” (সূরা আল-আ’লা: ১৪-১৭)

কবর জিয়ারত মানুষের মনে আখিরাতের গুরুত্ব সৃষ্টি করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শেখায়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন তোমরা কবর জিয়ারত করতে পারো, কারণ এটি মৃত্যু এবং আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।” (মুসলিম, হাদিস: ৯৭৬)

রাসূল (সা.) প্রথমদিকে কবর জিয়ারত নিষিদ্ধ করেছিলেন, কারণ তৎকালীন মুশরিকরা কবর পূজা করত। পরে যখন মুসলমানদের ঈমান মজবুত হলো, তখন তিনি কবর জিয়ারত করার অনুমতি দিলেন, যাতে তারা আখিরাতের কথা স্মরণ করতে পারে এবং মৃতদের জন্য দোয়া করতে পারে।

কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্য ও উপকারিতা

কবর জিয়ারতের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের স্মরণ ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা। এটি শুধু মৃতদের জন্য দোয়া করার আমল নয়, বরং জীবিতদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যম।

১. মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করানো

  • কবর জিয়ারত করলে একজন মানুষ উপলব্ধি করে যে জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং প্রত্যেককেই একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে।
  • এটি পাপ থেকে দূরে থাকার এবং নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।

২. আত্মশুদ্ধি ও ঈমান বৃদ্ধি করা

  • মানুষ যখন কবরস্থানে যায়, তখন সে এই দুনিয়ার অসারতা বুঝতে পারে এবং আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য তওবা ও ইবাদতে মনোযোগী হয়।
  • এটি নরম হৃদয়ের সৃষ্টি করে এবং অহংকার কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

৩. মৃতদের জন্য দোয়া করার সুযোগ

  • মৃত ব্যক্তিরা নিজের জন্য দোয়া করতে পারে না, তাই জীবিতদের দায়িত্ব হলো তাদের জন্য দোয়া করা ও ইসালে সওয়াব করা।
  • রাসূল (সা.) বলেছেন:
    “যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি জিনিস চলতে থাকে – সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা মানুষ উপকৃত হয় এবং নেককার সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।” (মুসলিম, হাদিস: ১৬৩১)

কবর জিয়ারতের নিয়ম ও সুন্নতি পদ্ধতি

কবর জিয়ারতের জন্য প্রস্তুতি

কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত কবর জিয়ারতে যাওয়ার আগে, যাতে এটি সুন্নত ও শরিয়তের বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

১. ওযু করা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা

  • ওযু করা সুন্নত, তবে ফরজ নয়।
  • পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা উচিত।
  • অশালীন বা অপবিত্র পোশাক পরে কবরস্থানে যাওয়া উচিত নয়।

২. কবরস্থানে যাওয়ার নিয়ত করা

  • শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ বা দেখানোর জন্য কবর জিয়ারত করা যাবে না।
  • আখিরাতের কথা স্মরণ করা ও মৃতদের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যেই কবর জিয়ারতে যেতে হবে।

৩. কবর জিয়ারতের সময় আদব বজায় রাখা

  • কবরস্থানে ঢুকলে শান্তভাবে প্রবেশ করা এবং উচ্চস্বরে কথা না বলা সুন্নত।
  • হাসাহাসি, মজা বা গাফিলতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কবর জিয়ারতের সুন্নত দোয়া ও আদব

কবর জিয়ারতের সময় পড়ার দোয়া

কবরস্থানে প্রবেশ করলে রাসূল (সা.) আমাদের বিশেষ দোয়া পড়তে শিখিয়েছেন, যা মৃতদের জন্য রহমত ও মাগফিরাত কামনার মাধ্যম।

রাসূল (সা.) এর শেখানো দোয়া:

السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ لَلَاحِقُونَ، أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ

উচ্চারণ:
“আস-সালামু আলাইকুম আহলাদ দিয়ার মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুসলিমিন, ওয়া ইন্না ইন শা আল্লাহু লালাহিকুন, আসআলুল্লাহা লানা ওয়ালাকুমুল আফিয়া।”

বাংলা অর্থ:
“হে মুমিন ও মুসলমানদের আবাসস্থলের বাসিন্দারা! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইন শা আল্লাহ, আমরাও তোমাদের সাথে যোগ দেব। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের এবং আমাদের জন্য শান্তি ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” (মুসলিম, হাদিস: ৯৭৫)

কবর জিয়ারতের অন্যান্য দোয়া

কবর জিয়ারতের সময় ইস্তিগফার পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং মৃতদের জন্য দোয়া করা সুন্নত।

রাসূল (সা.) এর কবর জিয়ারতের আদর্শ পদ্ধতি

রাসূলুল্লাহ (সা.) কবর জিয়ারত সম্পর্কে আমাদের একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা আমাদের সঠিক নিয়ম মেনে কবর জিয়ারত করতে সাহায্য করে।

রাসূল (সা.) কিভাবে কবর জিয়ারত করতেন?

  • তিনি কবরস্থানে গিয়ে সালাম দিতেন এবং দোয়া করতেন।
  • কবরবাসীদের জন্য রহমত ও মাগফিরাত কামনা করতেন।
  • তিনি কবরের সামনে দণ্ডায়মান হয়ে ধীরে ধীরে দোয়া পড়তেন।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত:
“রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করেন এবং কেঁদে ফেলেন, এরপর তিনি বলেন, ‘তোমরা কবর জিয়ারত করো, এটি তোমাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’” (ইবন মাজাহ: ১৫৭২)

সাহাবাদের কবর জিয়ারতের আমল ও দোয়া

  • আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.) নিয়মিত কবর জিয়ারত করতেন এবং মৃতদের জন্য দোয়া করতেন।

রাসূল (সা.) এর শিক্ষা অনুযায়ী কবর জিয়ারতের সঠিক পদ্ধতি

  • শান্তভাবে প্রবেশ করা ও দোয়া পড়া।
  • মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করা।
  • কোনো শিরক বা বিদআতমূলক কাজ না করা।

মহিলাদের কবর জিয়ারত করা কি বৈধ?

ইসলামি শরীয়তে মহিলাদের কবর জিয়ারতের বিধান

মহিলাদের কবর জিয়ারত সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, তবে মূলত এটি শর্তসাপেক্ষে বৈধ

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, তবে এখন তোমরা কবর জিয়ারত করতে পারো” (মুসলিম, হাদিস: ৯৭৬)

এই হাদিসের ভিত্তিতে পুরুষদের মতো মহিলারাও সঠিক নিয়ম মেনে কবর জিয়ারত করতে পারেন

মহিলাদের কবর জিয়ারতের শর্তাবলী

  • সঠিক নিয়ম মেনে কবর জিয়ারত করা যাবে, কিন্তু শোক প্রকাশের নামে চিৎকার বা বিলাপ করা হারাম।
  • পুরুষদের সঙ্গে একত্রে ভিড়ে না মিশে শালীন পোশাক পরে যাওয়া উচিত।
  • শান্তভাবে প্রবেশ করা ও সুন্নত দোয়া পড়া।
  • কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ইবাদতের নামে কোনো শিরক বা বিদআতমূলক কাজ না করা।

আয়েশা (রা.) কবর জিয়ারত সম্পর্কে বলেন:
“রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে কবর জিয়ারতের দোয়া শিখিয়েছেন।” (মুসলিম)

কবর জিয়ারতের সময় মহিলাদের জন্য করণীয় ও সতর্কতা

শান্ত ও সংযত আচরণ বজায় রাখা।
শালীন পোশাক পরিধান করা ও পর্দা বজায় রাখা।
কবরবাসীদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করা।
কবর স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া বা মাটি নেওয়া নিষিদ্ধ।
চিৎকার বা বিলাপ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

কবর জিয়ারতের সময় প্রচলিত ভুল ধারণা ও বিদআত

অনেক মুসলমান কবর জিয়ারতের সুন্নত পদ্ধতি না জেনে কিছু ভুল আমল করে থাকেন, যা ইসলামে অনুমোদিত নয়। বিদআত ও শিরক থেকে মুক্ত থেকে সঠিক নিয়মে কবর জিয়ারত করা জরুরি।

কবর জিয়ারতের সময় যে ভুল কাজগুলো করা উচিত নয়

১. কবর স্পর্শ করা, চুমু খাওয়া বা মাটি নেওয়া

  • অনেকেই কবরের মাটি স্পর্শ করে মনে করেন যে এতে বরকত আছে, যা সম্পূর্ণ ভুল।
  • রাসূল (সা.) বা সাহাবিরা কখনো এভাবে কবর স্পর্শ বা চুমু খাননি।

২. উচ্চস্বরে কান্নাকাটি ও বিলাপ করা

  • অনেকে কবর জিয়ারতের সময় উচ্চস্বরে কাঁদেন ও বিলাপ করেন, যা ইসলামসম্মত নয়।
  • রাসূল (সা.) বলেন:
    “মৃত ব্যক্তির আত্মাকে তার আত্মীয়-স্বজনদের বিলাপ দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়।” (বুখারি: ১২৯২, মুসলিম: ৯৩৩)

২. কবরের চারপাশে ঘোরা বা ধূপ-ধুনো জ্বালানো

  • অনেকে মনে করেন, কবরের চারপাশে সাতবার ঘুরলে বা ধূপ-ধুনো জ্বালালে মৃত ব্যক্তি সন্তুষ্ট হন, যা ইসলামে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
  • ইসলামে কবরকে উপাসনার স্থান বানানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

কবর জিয়ারতের সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

কবর জিয়ারত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল, তবে এটি শিরক ও বিদআতমুক্ত হতে হবে।

রাসূল (সা.) বলেন:
“তোমরা কবরকে ঈদ (উৎসব) বানিয়ো না এবং আমার কবরকে পূজা করো না। তবে আমার উপর দুরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের দুরুদ আমার কাছে পৌঁছানো হয়।” (আবু দাউদ: ২০৪২)

সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি:
কবরস্থানে গিয়ে দোয়া পড়া ও মৃতদের জন্য ইস্তিগফার করা।
আখিরাতের কথা স্মরণ করা ও আত্মশুদ্ধি করা।
শিরক ও বিদআত থেকে দূরে থাকা।

কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্য

কবর জিয়ারতের প্রধান উদ্দেশ্য:

  • আখিরাতের কথা স্মরণ করা ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা।
  • মৃতদের জন্য দোয়া ও ইসালে সওয়াব করা।
  • শিরক ও বিদআত থেকে মুক্ত থেকে সুন্নতি আমল পালন করা।

আরও পড়ুন: জানাজার নামাজের দোয়া বাংলা অর্থ সহ : সঠিক পদ্ধতি ও ব্যাখ্যা

উপসংহার

কবর জিয়ারত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল, যা মানুষকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আত্মশুদ্ধির পথ দেখায়।

  1. সুন্নতি নিয়ম অনুযায়ী কবর জিয়ারত করলে এটি একটি প্রশংসনীয় আমল।
  2. কবর জিয়ারতের সময় সুন্নত দোয়া পড়া ও মৃতদের জন্য দোয়া করা উচিত।
  3. মৃতদের কাছে কিছু চাওয়া বা কবর পূজা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
  4. কবরের মাটি নেওয়া, ধূপ-ধুনো জ্বালানো, উচ্চস্বরে বিলাপ করা বিদআত ও হারাম।

 কবর জিয়ারতের মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজেকে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করতে পারেন এবং মৃতদের জন্য দোয়া করে তাদের উপকার করতে পারেন। তবে শিরক ও বিদআত থেকে বিরত থাকা জরুরি।

কবর জিয়ারতের নিয়ম : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top