পেভিসন ক্রিম কিসের কাজ করে? | দাউদ, একজিমা ও চুলকানিতে এর সঠিক ব্যবহার

পেভিসন ক্রিম কিসের কাজ করে, ত্বকে যখন দাউদ, একজিমা বা চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দেয় এবং সাধারণ কোনো ক্রিমে কাজ হয় না, তখন চিকিৎসকরা প্রায়ই পেভিসন (Pevisone) ক্রিমের মতো একটি শক্তিশালী ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু এর দুটি উপাদান এবং কার্যকারিতা নিয়ে অনেকের মনেই দ্বিধা তৈরি হয়। এটি কি শুধু ফাঙ্গাস তাড়ায়, নাকি চুলকানিও কমায়? এটি কি সবার জন্য নিরাপদ? ভুল ব্যবহারে কী ক্ষতি হতে পারে?

আপনার এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে এবং পেভিসন ক্রিমের নিরাপদ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেই আমাদের আজকের এই বিশদ আলোচনা।

এক নজরে: পেভিসন (Pevisone) ক্রিম

বিষয়তথ্য
ব্র্যান্ড নামপেভিসন (Pevisone)
জেনেরিক নামইকোনাজল নাইট্রেট ১% + ট্রায়ামসিনোলোন অ্যাসিটোনাইড ০.১% <br> (Econazole Nitrate 1% + Triamcinolone Acetonide 0.1%)
ঔষধের ধরণকম্বিনেশন ক্রিম (অ্যান্টিফাঙ্গাল + কর্টিকোস্টেরয়েড)
প্রধান কাজফাঙ্গাল ইনফেকশন এবং এর সাথে সম্পর্কিত চুলকানি, একজিমা ও সোরিয়াসিস-এর প্রদাহ দূর করা
প্রস্তুতকারকসাইনোভিয়া ফার্মা পিএলসি (Synovia Pharma PLC)
দাম (আনুমানিক)১০ গ্রামের টিউব -৳৭০ (সর্বশেষ মূল্য যাচাই করুন)

পেভিসন ক্রিম কীভাবে কাজ করে?

পেভিসন ক্রিমের কার্যকারিতার মূল রহস্য এর দুটি শক্তিশালী উপাদানের সমন্বয়ে। এটি একই সাথে দুটি ভিন্ন দিক থেকে কাজ করে:

  1. ফাঙ্গাস ধ্বংস করে (ইকোনাজল নাইট্রেট ১%): এই উপাদানটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিফাঙ্গাল। এটি দাউদ, ক্যানডিডা বা অন্যান্য ইনফেকশনের জন্য দায়ী ফাঙ্গাসের কোষ প্রাচীরকে (Cell Wall) আক্রমণ করে সেটিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ইনফেকশনের মূল কারণ অর্থাৎ ফাঙ্গাস গোড়া থেকে নির্মূল হয়।
  2. প্রদাহ ও চুলকানি কমায় (ট্রায়ামসিনোলোন অ্যাসিটোনাইড ০.১%): এটি একটি কর্টিকোস্টেরয়েড, যা খুব দ্রুত কাজ করে। ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কারণে ত্বক যখন লাল হয়ে ফুলে যায়, জ্বালাপোড়া করে এবং প্রচণ্ড চুলকায়, তখন এই উপাদানটি সেই প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিকগুলোকে দমন করে। ফলে মাত্র কয়েকবার ব্যবহারেই চুলকানি, লালচে ভাব ও অস্বস্তি নাটকীয়ভাবে কমে আসে।

এককথায়, পেভিসন ক্রিম একই সাথে রোগের কারণ (ফাঙ্গাস) নির্মূল করে এবং রোগের লক্ষণ (চুলকানি, প্রদাহ) থেকে দ্রুত মুক্তি দেয়

ব্যবহারের ক্ষেত্র: ডাক্তার কখন পেভিসন ক্রিম দেন?

চিকিৎসকরা সাধারণত সেইসব জটিল চর্মরোগের জন্য এটি নির্ধারণ করেন যেখানে ফাঙ্গাল ইনফেকশনের সাথে চুলকানি বা প্রদাহের মতো লক্ষণগুলো যুক্ত থাকে। এর প্রধান ব্যবহারগুলো হলো:

  • একজিমাটাস মাইকোসেস (Eczematous Mycoses): যখন একজিমার সাথে ফাঙ্গাল ইনফেকশন মিশে থাকে, তখন এই ক্রিম প্রদাহ ও ইনফেকশন একসাথে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • সোরিয়াসিস (Psoriasis): সোরিয়াসিসে আক্রান্ত স্থানে যখন সেকেন্ডারি ফাঙ্গাল ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তখন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এটি ব্যবহৃত হয়।
  • টিনিয়া ইনফেকশন (দাউদ): শরীরের যেকোনো স্থানের দাউদ, বিশেষ করে যেখানে চুলকানি ও প্রদাহ খুব বেশি।
  • কুঁচকির চুলকানি (Jock Itch): তীব্র চুলকানিযুক্ত ফাঙ্গাল ইনফেকশন যা সাধারণত কুঁচকি বা উরুর ভাঁজে হয়।
  • অ্যাথলেট’স ফুট (Athlete’s Foot): পায়ের আঙুলের ফাঁকে তীব্র চুলকানি ও প্রদাহযুক্ত ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্য।
  • ক্যানডিডিয়াসিস (Candidiasis): ত্বকের আর্দ্র ভাঁজগুলোতে (যেমন বগলের নিচে) ইনফেকশনের কারণে সৃষ্ট লাল র‍্যাশ ও চুলকানির চিকিৎসায়।

সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহারবিধি

এই ঔষধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা এর সঠিক প্রয়োগের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

কীভাবে লাগাবেন:

  1. স্থান প্রস্তুত করুন: আক্রান্ত স্থানটি হালকা সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে নরম কাপড় দিয়ে আলতোভাবে শুকিয়ে নিন।
  2. অল্প পরিমাণে নিন: আঙুলের ডগায় সামান্য পরিমাণ (আক্রান্ত স্থানের জন্য যতটুকু প্রয়োজন) ক্রিম নিন।
  3. আলতো করে লাগান: আক্রান্ত স্থানে এবং তার চারপাশের সামান্য অংশে ক্রিমের একটি পাতলা স্তর আলতো করে ম্যাসাজ করে লাগিয়ে দিন। জোরে ঘষাঘষি করবেন না।
  4. হাত পরিষ্কার করুন: ক্রিম লাগানোর পর অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলুন, যাতে অন্য কোথাও না লাগে।

যা করা থেকে বিরত থাকবেন:

  • ক্রিম লাগানোর পর স্থানটি ব্যান্ডেজ বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখবেন না, যদি না চিকিৎসক বিশেষভাবে বলেন।
  • চোখ, নাক বা মুখের ভেতরে যেন ক্রিম না লাগে সেদিকে সতর্ক থাকুন।
  • কাটা, পোড়া বা খোলা ক্ষতের উপর এই ক্রিম লাগাবেন না।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:

সঠিকভাবে অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করলে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সাধারণত কম। তবে স্টেরয়েড থাকার কারণে কিছু ঝুঁকি থেকেই যায়।

  • সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া: প্রয়োগের স্থানে হালকা জ্বালাপোড়া, শুষ্কতা বা সামান্য চুলকানি।
  • কম দেখা যায়: ত্বকের রঙ হালকা পরিবর্তন, ত্বকে চুলের বৃদ্ধি।
  • গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (দীর্ঘদিন ব্যবহারে):
    • ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া (Skin atrophy)।
    • ত্বকে ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্কস (Stretch marks) তৈরি হওয়া।
    • ব্রণের মতো ফুসকুড়ি বা রোসাসিয়া (Rosacea) দেখা দেওয়া।

পেভিসন ব্যবহারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা

এই অংশটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, কারণ ভুল ব্যবহারে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

  • মুখে ব্যবহার কঠোরভাবে নিষেধ: চিকিৎসকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই পেভিসন ক্রিম মুখে, বিশেষ করে ব্রণের জন্য বা ফর্সা হওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না। এটি মুখের নাজুক ত্বককে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
  • এটি ফর্সা হওয়ার ক্রিম নয়: পেভিসন ত্বকের প্রদাহ কমায় বলে সাময়িকভাবে উজ্জ্বল লাগতে পারে, কিন্তু এটি কোনো ফেয়ারনেস ক্রিম নয়। এই উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার ত্বককে পাতলা ও দুর্বল করে ফেলে।
  • শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন: শিশুদের ত্বকে এর ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
  • দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একটানা ৭-১৪ দিনের বেশি ব্যবহার করবেন না। চুলকানি কমে যাওয়ার পর শুধু অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম ব্যবহার করা নিরাপদ।
  • গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদান: গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে এর ঝুঁকি ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQ)

প্রশ্ন ১: চুলকানি কমার পর কি ক্রিম ব্যবহার বন্ধ করে দেব? উত্তর: না। চুলকানি দ্রুত কমতে পারে স্টেরয়েডের কারণে, কিন্তু ফাঙ্গাস পুরোপুরি নির্মূল হতে সময় লাগে। ফাঙ্গাসকে গোড়া থেকে শেষ করতে চিকিৎসকের নির্ধারিত কোর্স (যেমন ৭ বা ১৪ দিন) সম্পন্ন করা জরুরি।

প্রশ্ন ২: পেভিসন এবং ক্লোট্রিমাজোল (Clotrimazole) ক্রিমের মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তর: ক্লোট্রিমাজোল একটি সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম, যা শুধু ফাঙ্গাস মারে। অন্যদিকে, পেভিসন একটি কম্বিনেশন ক্রিম যা ফাঙ্গাস মারার পাশাপাশি স্টেরয়েডের মাধ্যমে চুলকানি ও প্রদাহও দ্রুত কমায়। তাই এটি বেশি তীব্র সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়।

প্রশ্ন ৩: পেভিসন দিনে কতবার ব্যবহার করতে হয়? উত্তর: সাধারণত দিনে এক থেকে দুইবার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে আপনার সমস্যার তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসকই সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন।

দাবিত্যাগ (Disclaimer)

এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ তথ্যভিত্তিক এবং জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে রচিত। এটি কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। যেকোনো ঔষধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।

তথ্যসূত্র (References)

  1. Synovia Pharma PLC – Official Product Information
  2. National Health Service (NHS), UK – Topical Corticosteroids
  3. Medscape – Drug & Disease Database

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top