স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি ? বাংলা ভাষার অক্ষর গঠনের মূল ভিত্তি হলো স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। বাংলা ভাষার বর্ণমালাকে বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কী এবং এদের সংখ্যা কত।
বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা। এর অক্ষর, উচ্চারণ, ব্যাকরণ এবং গঠনশৈলী বাংলা ভাষাকে অনন্য করে তুলেছে। বাংলা বর্ণমালায় প্রধানত দুটি ধরণের অক্ষর থাকে – স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। এ দুটি একসঙ্গে মিলেই বাংলা ভাষার শব্দগঠন ও বাক্যগঠন হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি? অনেকেই এই বিষয়ে বিভ্রান্ত থাকেন। কারণ বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও উচ্চারণগত পরিবর্তনের কারণে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। এই নিবন্ধে আমরা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের প্রকৃত সংখ্যা, সংজ্ঞা এবং তাদের ব্যবহারের বিশদ ব্যাখ্যা দেব।
বাংলা বর্ণমালা পরিচিতি
বাংলা ভাষার বর্ণমালা হলো একগুচ্ছ অক্ষর যা বাংলা শব্দ গঠনের মূল উপাদান। বাংলা ভাষার বর্ণমালা দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
- স্বরবর্ণ (Vowels) – স্বয়ংসম্পূর্ণ উচ্চারণযুক্ত অক্ষর
- ব্যঞ্জনবর্ণ (Consonants) – স্বরবর্ণ ছাড়া উচ্চারিত হতে অক্ষম অক্ষর
বাংলা বর্ণমালার মোট অক্ষর কয়টি?
বাংলা বর্ণমালায় ৫০টি অক্ষর রয়েছে। এর মধ্যে:
- ১১টি স্বরবর্ণ
- ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ
তবে, অনেক পুরনো বই এবং পাঠ্যপুস্তকে স্বরবর্ণের সংখ্যা ৭ বলা হয় (অ, আ, ই, উ, এ, ও, ঋ)। কিন্তু আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী, সম্পূর্ণ স্বরধ্বনি প্রকাশ করতে ১১টি স্বরবর্ণ ধরা হয়।
স্বরবর্ণ: সংজ্ঞা, সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্য
এই বর্ণ হলো এমন অক্ষর যা উচ্চারণের জন্য অন্য কোনো ধ্বনির সাহায্য নেয় না। অর্থাৎ, স্বরবর্ণ নিজে নিজেই উচ্চারিত হতে পারে এবং কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের সাহায্য ছাড়াই স্পষ্টভাবে ধ্বনিত হয়।
স্বরবর্ণ কয়টি?
বাংলা ভাষায় মোট ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ।
এগুলোর প্রতিটি ধ্বনি বাংলা ভাষায় স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখে। উচ্চারণভেদে এগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- হ্রস্ব স্বরবর্ণ – ই, উ, ঋ (সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ)
- দীর্ঘ স্বরবর্ণ – আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ (প্রলম্বিত উচ্চারণ)
বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের গুরুত্ব
- শব্দ গঠনের জন্য স্বরবর্ণ অপরিহার্য
- সঠিক উচ্চারণ ও বানানচর্চার ক্ষেত্রে স্বরবর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
- বাংলা কাব্য ও সাহিত্যিক উচ্চারণে স্বরবর্ণের ব্যতিক্রমী ব্যবহার রয়েছে
ব্যঞ্জনবর্ণ: সংজ্ঞা, সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্য
আর ব্যঞ্জনবর্ণ হলো এমন অক্ষর, যা উচ্চারণের জন্য স্বরবর্ণের সহায়তা প্রয়োজন হয়। একা ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারিত হতে পারে না, বরং এটি স্বরবর্ণের সঙ্গে মিলেই একটি সম্পূর্ণ শব্দ তৈরি করে।
ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি?
বাংলা ভাষায় মোট ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে। এগুলো হলো:
ক, খ, গ, ঘ, ঙ,
চ, ছ, জ, ঝ, ঞ,
ট, ঠ, ড, ঢ, ণ,
ত, থ, দ, ধ, ন,
প, ফ, ব, ভ, ম,
য, র, ল, শ, ষ, স,
হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ,ং,ঃ, ঁ।
ব্যঞ্জনবর্ণের বৈশিষ্ট্য:
ব্যঞ্জনবর্ণ একা উচ্চারিত হতে পারে না
বাংলা শব্দের অধিকাংশ গঠনে ব্যঞ্জনবর্ণ অপরিহার্য
উচ্চারণভেদে ব্যঞ্জনবর্ণ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত।
উচ্চারণভেদে ব্যঞ্জনবর্ণের শ্রেণিবিভাগ
ব্যঞ্জনবর্ণকে উচ্চারণ ও উৎপত্তিস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়:
ধরন | ব্যঞ্জনবর্ণ |
কণ্ঠ্য (গলা থেকে উচ্চারিত) | ক, খ, গ, ঘ, ঙ |
তালব্য (তালু থেকে উচ্চারিত) | চ, ছ, জ, ঝ, ঞ |
মূর্ধন্য (জিহ্বার উঁচু অংশ থেকে উচ্চারিত) | ট, ঠ, ড, ঢ, ণ |
দন্ত্য (দাঁতের সাহায্যে উচ্চারিত) | ত, থ, দ, ধ, ন |
ওষ্ঠ্য (ঠোঁট ব্যবহার করে উচ্চারিত) | প, ফ, ব, ভ, ম |
অন্যান্য (বিভিন্ন অংশ থেকে উচ্চারিত) | য, র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ,ং, ঃ, ঁ |
এই শ্রেণিবিভাগ জানলে বাংলা উচ্চারণ আরও সহজ হয়।
বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের গুরুত্ব
বাংলা ভাষার সঠিক গঠন ও উচ্চারণের জন্য স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এদের উপস্থিতি বাংলা ভাষাকে স্বতন্ত্র করে তোলে এবং ভাষার গঠনশৈলীতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বাক্য গঠনে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ভূমিকা
- ব্যঞ্জনবর্ণ একা উচ্চারিত হতে পারে না, তাই স্বরবর্ণ ছাড়া কোনো বাংলা শব্দ গঠন সম্ভব নয়।
- ব্যঞ্জনবর্ণ ও স্বরবর্ণ একত্রে শব্দ তৈরি করে, যেমন: ‘কলা’ (ক+অ+ল+আ)
- আর বাংলা ব্যাকরণে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সমন্বয়ই শব্দ ও বাক্য গঠনের মূলনীতি তৈরি করে।
বাংলা বানানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের প্রভাব
- বাংলা বানানশৈলী মূলত স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
- অনেক শব্দের বানান ভুল হয় কারণ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক প্রয়োগ জানার অভাব থাকে।
- ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবর্তন বা সংমিশ্রণে বাংলা ভাষায় নতুন শব্দের জন্ম হয়।
বাংলা ভাষার উচ্চারণগত সৌন্দর্য বৃদ্ধি
বাংলা ভাষার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ভাষার উচ্চারণগত সৌন্দর্য বাড়ে। বিশেষত কবিতা, গান ও সাহিত্যিক রচনায় এদের সংযোজন বাংলা ভাষাকে আরও প্রাঞ্জল করে তোলে।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের উপর ভিত্তি করেই বাংলা ভাষা গঠিত। তাই বাংলা ভাষাকে শুদ্ধভাবে শেখার জন্য এদের বিস্তারিতভাবে জানা জরুরি।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ও সাধারণ ভুল
বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে, যা অনেক শিক্ষার্থী ও ভাষাপ্রেমীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে। আসুন, এই ভুল ধারণাগুলো দূর করি।
স্বরবর্ণ ৭ নাকি ১১?
অনেক পুরনো ব্যাকরণ বইতে স্বরবর্ণের সংখ্যা ৭ বলা হয়েছে – (অ, আ, ই, উ, এ, ও, ঋ)। কিন্তু আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে বাংলা ভাষায় ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে – (অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ)।
কারণ: ১১টি স্বরবর্ণ বাংলা ভাষার শব্দ ও উচ্চারণের জন্য অপরিহার্য, তাই আধুনিক ব্যাকরণে এ সংখ্যা অনুসরণ করা হয়।
ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ
- কেউ বলে ৩৭টি ব্যঞ্জনবর্ণ, আবার কেউ বলে ৩৯টি।
- আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণই স্বীকৃত।
- কিছু ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ পরিবর্তন হওয়ায় এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে (যেমন: ড়, ঢ়, য়)।
বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের জন্য ১১টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি।
আধুনিক বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার
প্রযুক্তির প্রসারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ডিজিটাল মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, এই পরিবর্তনের ফলে অনেক নতুন চ্যালেঞ্জও এসেছে।
আজকের বাংলা ভাষায় উচ্চারণের পরিবর্তন
- অনেক শব্দের উচ্চারণ সহজ করার জন্য কিছু স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার পরিবর্তন হয়েছে।
- উদাহরণ: ‘বৃদ্ধি’ → ‘বৃদি’, ‘স্বাস্থ্য’ → ‘সাত্ত’ (কথ্য ভাষায় পরিবর্তন)।
ডিজিটাল যুগে বাংলা লেখার সহজীকরণ
- এখন ইউনিকোড পদ্ধতি ও অভ্র কীবোর্ডের মাধ্যমে বাংলা লেখা সহজ হয়েছে।
- অনেক মানুষ এখন ফোন, কম্পিউটার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে।
তবে, বাংলা বানান ও উচ্চারণ শুদ্ধ রাখতে ব্যাকরণের নিয়ম অনুসরণ করা জরুরি।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
১. বাংলা ভাষায় মোট কতটি বর্ণ আছে?
বাংলা ভাষায় মোট ৫০টি বর্ণ রয়েছে – ১১টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ।
২. স্বরবর্ণ কয়টি?
বাংলা ভাষায় ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ।
৩. ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি?
বাংলা ভাষায় ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে, যেমন: ক, খ, গ, ঘ, ঙ থেকে শুরু করে ঁ পর্যন্ত।
৪. স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পার্থক্য কী?
স্বরবর্ণ একা উচ্চারিত হতে পারে, কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণের জন্য স্বরবর্ণের সাহায্য প্রয়োজন হয়।
৫. স্বরবর্ণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
স্বরবর্ণ বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনের মূল উপাদান, যা সঠিক উচ্চারণ ও বানানের জন্য অপরিহার্য।
৬. ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণভেদে কিভাবে ভাগ করা হয়?
ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী ৬টি ভাগে বিভক্ত: কণ্ঠ্য, তালব্য, মূর্ধন্য, দন্ত্য, ওষ্ঠ্য ও অন্যান্য।
৭. বাংলা বানানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কীভাবে প্রভাব ফেলে?
বাংলা বানানের শুদ্ধতা নির্ভর করে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক প্রয়োগের ওপর।
৮. স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ শুদ্ধভাবে শেখার উপায় কী?
নিয়মিত পড়াশোনা, বাংলা ব্যাকরণ চর্চা এবং শুদ্ধ উচ্চারণ অনুশীলনের মাধ্যমে শেখা সম্ভব।
৯. ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার পরিবর্তন কেমন?
ইউনিকোড ও অভ্র কীবোর্ডের কারণে বাংলা লেখা সহজ হয়েছে, তবে উচ্চারণ ও বানান ঠিক রাখা জরুরি।
আরও পড়ুন: ব্যাকরণ কাকে বলে ? বাংলা ব্যাকরণের মূল ধারণা, প্রকারভেদ এবং শিখন পদ্ধতি
উপসংহার
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ বাংলা ভাষার ভিত্তি। বাংলা ভাষার শব্দ, বাক্য ও উচ্চারণ ঠিক রাখতে ১১টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন।
এই নিবন্ধ থেকে আমরা শিখলাম:
বাংলা ভাষার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের প্রকৃত সংখ্যা
বাংলা বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ ও শ্রেণিবিভাগ
আধুনিক বাংলায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবর্তন ও ব্যবহার
বাংলা বানানের সঠিক নিয়ম অনুসরণের গুরুত্ব
বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই মূল জ্ঞান সংরক্ষণ করা জরুরি। তাই, আমরা সবাই যদি বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ও বানানচর্চা করি, তাহলে আমাদের ভাষা আরও সমৃদ্ধ হবে।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!