রিসালাত শব্দের অর্থ কি ? “রিসালাত” একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো “বার্তা”, “সংবাদ” অথবা “প্রেরিত বাণী”। ইসলামী পরিভাষায় রিসালাত বলতে বোঝায় আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের নিকট সত্য দ্বীন ও জীবনপথ পৌঁছানোর দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনকারী সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে রাসূল বা বার্তাবাহক বলা হয়। রিসালাত ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক স্তম্ভ, যার উপর ঈমান আনা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। এটি আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যোগাযোগের এক বিশেষ মাধ্যম, যা মানবজাতিকে সরল পথের দিশা দান করে।
এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হলো, “রিসালাত” শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য, রিসালাতের প্রকারভেদ এবং প্রথম রাসূল থেকে শেষ রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত রিসালাতের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা। এই তথ্যগুলো পাঠকদের রিসালাতের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবন করতে এবং ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করবে।
রিসালাত শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ: ভাষার প্রেক্ষাপট ও শরীয়তের সংজ্ঞা
“রিসালাত” শব্দটি আরবি ভাষা এবং ইসলামী শরীয়তে বিশেষ অর্থ বহন করে।
- আরবি ভাষায় “রিসালাত” শব্দের মূল অর্থ:
- আরবি ভাষায় “রিসালাত” (رِسَالَة) শব্দটি “আরসালা” (أَرْسَلَ) মূলধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো “প্রেরণ করা”, “পাঠানো” অথবা “প্রেরের দায়িত্ব দেওয়া”।
- এর শাব্দিক অর্থ হলো কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো বার্তা বা সংবাদ প্রেরণ করা।
- ইসলামী শরীয়তে রিসালাতের পারিভাষিক সংজ্ঞা:
- “ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় রিসালাত বলতে বোঝায়—এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কিছু মনোনীত বান্দার (নবী ও রাসূলগণের) ওপর অর্পিত এক মহান দায়িত্ব, যার মাধ্যমে তারা মানবজাতির প্রতি আল্লাহর বাণী, বিধান ও জীবন চলার সঠিক পথনির্দেশ পৌঁছে দেন।”
- রিসালাত হলো আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এক বিশেষ যোগসূত্র, যা নবীদের মাধ্যমে স্থাপিত হয়।
- রিসালাত ও নবী, রাসূল, ওহী শব্দের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য:
- নবী (نَبِيّ): নবী শব্দের অর্থ হলো “সংবাদদাতা”। ইসলামী শরীয়তে নবী হলেন সেই ব্যক্তি, যার কাছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ওহী আসে এবং যিনি পূর্ববর্তী শরীয়তের অনুসরণ করেন।
- রাসূল (رَسُول): রাসূল শব্দের অর্থ হলো “প্রেরিত ব্যক্তি” বা “বার্তাবাহক”। রাসূল হলেন সেই নবী, যার কাছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নতুন শরীয়ত অথবা বিশেষ বার্তা প্রেরিত হয় এবং যিনি তা প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। সকল রাসূলই নবী, কিন্তু সকল নবী রাসূল নন।
- ওহী (وَحْي): ওহী হলো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবী ও রাসূলগণের কাছে বার্তা প্রেরণের মাধ্যম, যা বিভিন্ন রূপে হতে পারে (যেমন: সরাসরি বাণী, ফেরেশতার মাধ্যমে, স্বপ্নযোগে)। রিসালাত ওহীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
“রিসালাত” শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য জানা অপরিহার্য।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে রিসালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: ঐশী নির্দেশনার অপরিহার্যতা
কুরআন ও হাদিসে রিসালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে।
- রিসালাতের অপরিহার্যতা ও আল্লাহর বিধান প্রেরণের মাধ্যম:
- আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। রিসালাতই হলো আল্লাহর বিধান মানুষের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম।
- কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে: “আর প্রত্যেক জাতির জন্যই পথপ্রদর্শক (রাসূল) রয়েছে।” (সূরা আর-রা’দ, আয়াত: ৭)।
- রিসালাতের উপর ঈমানের গুরুত্ব ও এর তাৎপর্য:
- রিসালাতের উপর ঈমান আনা ইসলামের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম। এর অর্থ হলো আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত সকল নবী ও রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাঁদের আনীত শরীয়তকে সত্য বলে মেনে নেওয়া।
- আর রিসালাতের উপর ঈমান আনা ব্যতীত কারো ঈমান পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।
- রিসালাত অস্বীকারের পরিণতি:
- রিসালাত অস্বীকার করা কুফরীর শামিল এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। যারা নবী ও রাসূলগণের প্রতি অবিশ্বাস স্থাপন করে, তারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং চিরস্থায়ী শাস্তির যোগ্য হয়।
- কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে: “আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদেরকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও রাসূলদের মাঝে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে, ‘আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি’ এবং তারা মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়, তারাই হলো প্রকৃত কাফির এবং আমি কাফিরদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অপমানজনক শাস্তি।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৫০-১৫১)।
কুরআন ও হাদিসের এই সুস্পষ্ট বক্তব্য রিসালাতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা প্রমাণ করে।
রিসালাতের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য: ঐশী বার্তার ভিন্নতা ও অভিন্নতা
রিসালাতকে মূলত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় এবং এর কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
- সাধারণ রিসালাত ও বিশেষ রিসালাতের ধারণা:
- সাধারণ রিসালাত: এর অর্থ হলো সকল নবী ও রাসূলের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে মৌলিক বার্তা ও দিকনির্দেশনা প্রেরণ করা হয়েছে। এই মৌলিক বার্তাগুলো মূলত তাওহীদ (একত্ববাদ), আখিরাত (পরকাল) এবং সৎকর্মের প্রতি আহ্বান কেন্দ্রিক।
- বিশেষ রিসালাত: এর অর্থ হলো কিছু রাসূলের উপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বিশেষ শরীয়ত বা বিধি-বিধান অবতীর্ণ হয়েছে, যা তাঁদের উম্মতের জন্য প্রযোজ্য ছিল। যেমন: মুসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত এবং ঈসা (আঃ)-এর উপর ইঞ্জিল।
- সকল নবীর রিসালাতের মূলনীতি ও অভিন্নতা:
- সকল নবী ও রাসূলের রিসালাতের মূলনীতি ছিল এক ও অভিন্ন – আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত এবং সৎকর্মের প্রতি আহ্বান। তাঁদের মৌলিক শিক্ষা ছিল একই, যদিও বাহ্যিক শরীয়তের কিছু বিধি-বিধানে পার্থক্য ছিল।
- বিশেষ রাসূলগণের বৈশিষ্ট্য ও তাঁদের শরীয়তের স্বাতন্ত্র্য:
- বিশেষ রাসূলগণ (যেমন: নূহ, ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁদের উপর অবতীর্ণ কিতাব এবং বিশেষ শরীয়তের মাধ্যমে স্ব স্ব উম্মতকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
- শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রিসালাত সকল পূর্ববর্তী রিসালাতের পূর্ণতা এবং তাঁর শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
রিসালাতের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা নবীদের দাওয়াতের ধারাবাহিকতা ও বিশেষত্ব বুঝতে সাহায্য করে।
প্রথম রাসূল থেকে শেষ রাসূল (সাঃ): রিসালাতের সোনালী পরম্পরা
আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন, যার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে।
- মানবজাতির জন্য প্রেরিত প্রথম রাসূল আদম (আঃ):
- অনেক আলেমের মতে, আদম (আঃ) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রেরিত প্রথম নবী এবং রাসূল। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সরাসরি জ্ঞান দান করেছিলেন এবং জীবনধারণের নিয়ম-কানুন শিখিয়েছিলেন।
- নূহ (আঃ), ইব্রাহিম (আঃ), মুসা (আঃ), ঈসা (আঃ) সহ অন্যান্য নবীদের রিসালাত:
- নূহ (আঃ) তাঁর জাতিকে মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম (আঃ) মূর্তি পূজা ও শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মুসা (আঃ) বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং তাওরাতের বিধান নিয়ে এসেছেন। ঈসা (আঃ) ইঞ্জিলের মাধ্যমে আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন এবং আধ্যাত্মিকতার উপর জোর দিয়েছেন। এছাড়াও আরও অসংখ্য নবী ও রাসূল বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতিতে প্রেরিত হয়েছেন।
- শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর রিসালাতের পূর্ণতা ও বৈশিষ্ট্য:
- মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন শেষ নবী এবং রাসূল। তাঁর উপর নবুওয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। তাঁর আনীত কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব এবং তাঁর শরীয়ত কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয়।
- তাঁর রিসালাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি সার্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ। পূর্ববর্তী সকল শরীয়তের ভালো দিকগুলো এতে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং যুগের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে বিধান দেওয়া হয়েছে।
রিসালাতের এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে মানবজাতির হিদায়েতের জন্য কত অনুগ্রহ করেছেন।
রিসালাতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য: ঐশী বার্তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
আল্লাহ তা’আলা নবী ও রাসূলগণকে মানবজাতির নিকট রিসালাতের বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন।
- তাওহীদের প্রতিষ্ঠা ও শিরকের মূলোৎপাটন:
- রিসালাতের প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল প্রকার শিরক (আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা) ও কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা। সকল নবী-রাসূল তাঁদের দাওয়াতের শুরুতেই এই মৌলিক বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন।
- মানবজাতির হেদায়েত ও সরল পথের দিশা দান:
- আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। রিসালাতের মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং কিভাবে ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা:
- রিসালাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো সমাজে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। নবী ও রাসূলগণ মানুষকে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে এবং দুর্বল ও অসহায়দের অধিকার রক্ষা করতে উৎসাহিত করেছেন।
- নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধন:
- রিসালাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বাতলে দিয়েছেন। নবীগণ মানুষকে সৎ গুণাবলী অর্জন করতে, চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করতে এবং আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে আহ্বান জানিয়েছেন।
রিসালাতের প্রমাণ ও নিদর্শন: সত্যের সুস্পষ্ট আলামত
আল্লাহ তা’আলা নবী ও রাসূলগণের রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন নিদর্শন ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন।
- নবীদের মুজিজা (অলৌকিক ঘটনাবলী):
- মুজিজা হলো নবীদের মাধ্যমে সংঘটিত এমন অলৌকিক ঘটনা, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মুজিজাগুলো তাঁদের রিসালাতের সত্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যেমন: মুসা (আঃ)-এর লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, ঈসা (আঃ)-এর মৃতকে জীবিত করা এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করা।
- আসমানী কিতাবসমূহ (যেমন: তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল, কুরআন):
- আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবী ও রাসূলগণের উপর অবতীর্ণ কিতাবসমূহ তাঁদের রিসালাতের সত্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এসব কিতাবে আল্লাহর বাণী এবং মানবজাতির জন্য জীবন চলার সঠিক পথনির্দেশ সন্নিবেশিত রয়েছে। কুরআন হলো সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের মূল বার্তা ধারণ করে এবং মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা স্বরূপ প্রেরিত হয়েছে।
- নবীদের চারিত্রিক মাধুর্য ও সত্যবাদিতা:
- নবী ও রাসূলগণ ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এবং তাঁরা ছিলেন সত্যবাদী ও বিশ্বাসী। তাঁদের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা তাঁদের রিসালাতের সত্যতার জীবন্ত প্রমাণ। তাঁদের শত্রুরাও তাঁদের সততা ও বিশ্বস্ততা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
- রিসালাতের যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ:
- রিসালাতের স্বপক্ষে বহু যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ বিদ্যমান। মানবজাতির স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পথপ্রদর্শক প্রেরণ করা যুক্তিসঙ্গত। রিসালাতের শিক্ষা মানব জীবনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং একটি সুশৃঙ্খল ও কল্যাণকর সমাজ গঠনে সহায়ক।
আর রিসালাতের এই প্রমাণ ও নিদর্শনগুলো বিবেকবান মানুষের জন্য সত্য উপলব্ধি করার সুস্পষ্ট আলামত।
রিসালাতের উপর ঈমানের প্রভাব: বিশ্বাসের ফলস্বরূপ জীবন
রিসালাতের উপর ঈমান আনা একজন মুমিনের জীবনে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
- আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন:
- রিসালাতের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর প্রতি আরও দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। সে জানতে পারে যে আল্লাহ দয়ালু ও ন্যায়বিচারক এবং তিনি মানবজাতির হেদায়েতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা করেছেন।
- নবীদের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য:
- রিসালাতের উপর ঈমান আনার অপরিহার্য অংশ হলো নবী ও রাসূলগণের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁদের আনুগত্য করা। বিশেষ করে শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ভালোবাসা ও তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা ঈমানের পূর্ণতার লক্ষণ।
- শরীয়তের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন:
- রিসালাতের উপর ঈমান আনার অর্থ হলো নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে যে শরীয়ত নিয়ে এসেছেন, তা আন্তরিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা। এর মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
- ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভ:
- রিসালাতের উপর সঠিকভাবে ঈমান আনলে এবং শরীয়তের অনুসরণ করলে বান্দা ইহকালে মানসিক শান্তি ও কল্যাণ লাভ করে এবং পরকালে আল্লাহর ক্ষমা ও মুক্তি লাভ করে।
রিসালাতের উপর ঈমান আনা একজন মুমিনের জীবনকে অর্থবহ ও সফল করে তোলে।
বর্তমান বিশ্বে রিসালাতের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব: আধুনিক প্রেক্ষাপটে ঐশী পথের দিশা
আধুনিক বিশ্বের জটিল ও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতেও রিসালাতের শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
- আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রিসালাতের শিক্ষা:
- বর্তমান বিশ্বে মানুষ বিভিন্ন ধরনের নৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। রিসালাতের শিক্ষা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
- বিশ্বশান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রিসালাতের ভূমিকা:
- রিসালাত ন্যায়বিচার, সাম্য ও শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য রিসালাতের শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য।
- নৈতিক অবক্ষয় রোধে রিসালাতের গুরুত্ব:
- আধুনিক সমাজে নৈতিক অবক্ষয় একটি বড় সমস্যা। রিসালাতের নৈতিক শিক্ষা মানুষকে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং উন্নত চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।
বর্তমান বিশ্বে রিসালাতের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই মানবজাতি কল্যাণ ও মুক্তি লাভ করতে পারে।
রিসালাত অস্বীকারের কুফল ও পরিণতি: সত্য প্রত্যাখ্যানের পরিণাম
রিসালাতের উপর ঈমান আনা যেমন অপরিহার্য, তেমনি তা অস্বীকার করার পরিণতিও অত্যন্ত ভয়াবহ।
- আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি:
- যারা আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত নবী ও রাসূলগণকে অস্বীকার করে, তারা মূলত আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে এবং তাঁর অসন্তুষ্টির পাত্র হয়। এর ফলে তারা ইহকালে বিভিন্ন প্রকার বিপদ ও কষ্টের সম্মুখীন হতে পারে এবং পরকালে কঠিন শাস্তির যোগ্য হবে।
- পথভ্রষ্টতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হওয়া:
- রিসালাত অস্বীকার করার কারণে মানুষ সত্য পথের দিশা হারায় এবং বিভিন্ন প্রকার ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়। নবীদের শিক্ষা ব্যতীত মানব সমাজ সঠিক জ্ঞান ও দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারে না।
- ইহকালীন অশান্তি ও পরকালীন দুর্ভোগ:
- রিসালাত অস্বীকারকারীরা ইহকালে মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের জীবন উদ্দেশ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরকালে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী দুর্ভোগ ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
রিসালাত অস্বীকারের এই কুফল ও পরিণতি মানবজাতিকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়ার এবং নবীদের শিক্ষাকে গ্রহণ করার প্রতি উৎসাহিত করে।
প্রশ্নোত্তর (FAQ): রিসালাত শব্দের অর্থ কি
- প্রশ্ন: রিসালাত শব্দের অর্থ কি? উত্তর: বার্তা, সংবাদ বা প্রেরিত বাণী; ইসলামী পরিভাষায় নবীদের উপর অর্পিত বার্তা ও দায়িত্ব।
- প্রশ্ন: ইসলামে রিসালাতের গুরুত্ব কতটুকু? উত্তর: অপরিসীম; ঈমানের স্তম্ভ ও মানবজাতির হেদায়েতের একমাত্র মাধ্যম; অস্বীকার করা কুফরী।
- প্রশ্ন: নবী ও রাসূলের মধ্যে পার্থক্য কি? উত্তর: নবী ওহীপ্রাপ্ত ও পূর্ববর্তী শরীয়ত অনুসরণকারী; রাসূল নতুন শরীয়ত বা বার্তা প্রচারের জন্য আদিষ্ট নবী।
- প্রশ্ন: রিসালাতের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো কি কি? উত্তর: তাওহীদ প্রতিষ্ঠা, মানবজাতির হেদায়েত, ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধন।
- প্রশ্ন: রিসালাতের উপর ঈমান আনার ফল কি? উত্তর: আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস, নবীদের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য, শরীয়তের অনুসরণ, ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি।
আরও পড়ুন: মাশাআল্লাহ অর্থ কি ? এর ব্যবহার ও ধর্মীয় গুরুত্ব
উপসংহার:
রিসালাত শব্দের অর্থ হলো ঐশী বার্তা প্রেরণ এবং এটি মানবজাতির জন্য আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। যুগে যুগে আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য বহু নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মাধ্যমে তিনি সত্য দ্বীন ও জীবন চলার সঠিক পথনির্দেশ মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন। রিসালাতের প্রতি ঈমান রাখা ইসলামের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ, যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও বিস্তৃত।
শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রিসালাতের মাধ্যমে নবুওয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে এবং তাঁর আনীত কুরআন হলো সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ আসমানী কিতাব। কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য তাঁর শিক্ষা ও শরীয়তই অনুসরণীয়। রিসালাতের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি ও বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই মানুষ ইহকালীন শান্তি ও কল্যাণ এবং পরকালীন মুক্তি লাভ করতে পারে। আসুন, আমরা সকলে রিসালাতের উপর ঈমান আনি এবং নবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি।
রিসালাত শব্দের অর্থ কি : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!