জোয়ার ভাটা কেন হয়: প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন

Mybdhelp.com-জোয়ার ভাটা কেন হয়
MyBdhelp গ্রাফিক্স

জোয়ার ভাটা কেন হয়, সমুদ্রের তীরে দাঁড়ালে ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল—এই দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে। তবে, সমুদ্রের জলের এই নিয়মিত ওঠানামার পেছনে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? হ্যাঁ, জোয়ার ভাটা প্রকৃতির তেমনই এক রহস্যময় ছন্দ, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে কৌতূহলী করে তুলেছে। প্রতিদিন দুবার করে সমুদ্রের জল বাড়ে আবার কমে—এই সাধারণ ঘটনার মূলে রয়েছে মহাজাগতিক শক্তির এক জটিল খেলা। এই আর্টিকেলে আমরা জোয়ার ভাটার সেই রহস্যের পর্দা উন্মোচন করব, জানব এর কারণ, প্রকারভেদ এবং আমাদের পৃথিবীর উপর এর প্রভাব সম্পর্কে।

মহাকর্ষের অদৃশ্য আকর্ষণ: জোয়ার ভাটার মূল চালিকাশক্তি

জোয়ার ভাটার প্রধান কারণ হলো মহাকর্ষীয় আকর্ষণ। চাঁদ এবং সূর্য—এই দুটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বস্তুর আকর্ষণ পৃথিবীর জলভাগের উপর এক অদৃশ্য টান তৈরি করে, যা জোয়ারের জন্ম দেয়। এর মধ্যে চাঁদের প্রভাবটাই মুখ্য।

চাঁদ পৃথিবীর তুলনায় ছোট হলেও, এর নৈকট্যের কারণে পৃথিবীর জলভাগের উপর শক্তিশালী আকর্ষণ প্রয়োগ করে। পৃথিবীর যে অংশে চাঁদ সরাসরি উপরে থাকে, সেখানকার জল চাঁদের আকর্ষণে ফুলে ওঠে—এটাই মুখ্য জোয়ার। মজার ব্যাপার হলো, একই সময়ে পৃথিবীর ঠিক বিপরীত দিকেও আরেকটি জোয়ার হয়। এর কারণ হলো কেন্দ্রাতিগ শক্তি, যা চাঁদ ও পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্টি হয়। চাঁদের আকর্ষণের এই ভিন্নতার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জোয়ারের উচ্চতা ও সময়ের পার্থক্য দেখা যায়।

সূর্যও জোয়ার ভাটায় অবদান রাখে, যদিও এর প্রভাব চাঁদের তুলনায় কম। কারণ সূর্য চাঁদের চেয়ে অনেক বড় হলেও পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তবে, যখন চাঁদ, সূর্য এবং পৃথিবী প্রায় একই সরলরেখায় আসে (পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়), তখন তাদের সম্মিলিত আকর্ষণ আরও শক্তিশালী জোয়ার সৃষ্টি করে—একে আমরা তেজ কটাল বা ভরা কোটাল বলি। এই মহাকর্ষের অদৃশ্য আকর্ষণই সমুদ্রের জলকে নিয়মিত ওঠানামা করায়।

পৃথিবীর ঘূর্ণন ও কেন্দ্রাতিগ শক্তি: ভারসাম্যের খেলা

শুধু মহাকর্ষীয় আকর্ষণই জোয়ার ভাটার একমাত্র কারণ নয়। পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণন এবং এর ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ শক্তিও এই প্রাকৃতিক ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর অনবরত ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের ফলে একটি বহির্মুখী শক্তি তৈরি হয়, যাকে কেন্দ্রাতিগ শক্তি বলে। এই শক্তি জলভাগকে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে ঠেলে দিতে চায়।

জোয়ার ও ভাটা আসলে এই দুই শক্তির সমন্বয়। একদিকে চাঁদের আকর্ষণ জলকে টেনে তোলে, অন্যদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ শক্তি বিপরীত দিকে জলকে ঠেলে দেয়। যখন কোনো স্থানে চাঁদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি থাকে, সেখানে জোয়ার হয়। আর এর বিপরীত দিকে কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবেও জোয়ার হয়। এই দুটি জোয়ারের মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে জল সরে যায়, ফলে ভাটার সৃষ্টি হয়।

পৃথিবীর একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই, সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে দুটি জোয়ার এবং দুটি ভাটা দেখা যায়, যাদের মধ্যে সময়ের পার্থক্য প্রায় ৬ ঘণ্টা। তবে, পৃথিবীর কক্ষপথ এবং অন্যান্য মহাজাগতিক কারণে এই সময়ে সামান্য হেরফের হতে পারে। পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং কেন্দ্রাতিগ শক্তির এই ভারসাম্যপূর্ণ interplay জোয়ার ভাটার নিয়মিত ছন্দ বজায় রাখে।

জোয়ার ভাটার প্রকারভেদ: প্রকৃতির নানান রূপ

জোয়ার ভাটা কেবল একই রকম হয় না। মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান এবং ভৌগোলিক কারণে এর বিভিন্ন রূপ দেখা যায়।

পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ার (তেজ কটাল বা ভরা কোটাল): যখন চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী প্রায় একই সরলরেখায় থাকে (পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়), তখন চাঁদ ও সূর্যের মিলিত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। এর ফলে যে জোয়ার হয়, তাকে তেজ কটাল বলে। এই সময় জোয়ারের জল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু হয় এবং ভাটার জল অনেক বেশি নেমে যায়।

মরা কোটাল: যখন চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সাথে সমকোণে অবস্থান করে (প্রথম ও তৃতীয় চতুর্থাংশের সময়), তখন তাদের আকর্ষণ একে অপরের প্রভাব কিছুটা কমিয়ে দেয়। এর ফলে যে জোয়ার হয়, তাকে মরা কোটাল বলে। এই সময় জোয়ারের জল স্বাভাবিকের চেয়ে কম উঁচু হয় এবং ভাটার জল তেমন বেশি নামে না।

দৈনিক জোয়ার: কিছু অঞ্চলে, যেমন মেক্সিকো উপসাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে, দিনে কেবল একটি জোয়ার এবং একটি ভাটা দেখা যায়। এর কারণ হলো স্থানীয় ভূখণ্ড এবং সমুদ্রের গভীরতা।

অর্ধ-দৈনিক জোয়ার: বিশ্বের বেশিরভাগ উপকূলীয় অঞ্চলে দিনে প্রায় সমান উচ্চতার দুটি জোয়ার এবং দুটি ভাটা দেখা যায়। আটলান্টিক মহাসাগর এবং ইউরোপের বেশিরভাগ উপকূলে এই ধরনের জোয়ার দেখা যায়।

মিশ্র জোয়ার: কিছু অঞ্চলে, যেমন উত্তর আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু অংশে, দিনে দুটি জোয়ার ও দুটি ভাটা দেখা গেলেও তাদের উচ্চতায় বেশ পার্থক্য থাকে। একে মিশ্র জোয়ার বলা হয়।

জোয়ার ভাটার এই বিভিন্ন প্রকারভেদ পৃথিবীর জলভাগের জটিল এবং গতিশীল প্রকৃতির পরিচয় দেয়।

অন্যান্য প্রভাব বিস্তারকারী কারণ

মহাকর্ষ এবং পৃথিবীর ঘূর্ণন ছাড়াও, আরও কিছু স্থানীয় ও সাময়িক কারণ জোয়ার ভাটার সময় ও উচ্চতার উপর প্রভাব ফেলে।

উপকূলের আকৃতি ও গভীরতা: খাঁড়ি, ফানেল আকৃতির উপকূল এবং অগভীর সমুদ্র জোয়ারের জলকে আটকে ফেলে এর উচ্চতা বাড়িয়ে দিতে পারে। কানাডার ফানডি উপসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু জোয়ার দেখা যাওয়ার প্রধান কারণ উপসাগরের বিশেষ আকৃতি।

সমুদ্রের তলদেশের ভূখণ্ড: সমুদ্রের তলদেশের বন্ধুরতা এবং ঢাল জোয়ারের ঢেউয়ের গতি ও উচ্চতাকে প্রভাবিত করে।

বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুচাপ: শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের জলকে একদিকে ঠেলে জোয়ারের উচ্চতা বাড়াতে পারে। নিম্নচাপও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সামান্য বৃদ্ধি করতে পারে।

ঝড় ও ঘূর্ণিঝড়: ঘূর্ণিঝড়ের সময় সৃষ্ট প্রবল বাতাস এবং অস্বাভাবিক বায়ুচাপের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে, যা ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।

এই স্থানীয় ও সাময়িক কারণগুলো জোয়ার ভাটার পূর্বাভাস দেওয়াকে আরও কঠিন করে তোলে, কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য এগুলো বিবেচনায় রাখা জরুরি।

জোয়ার ভাটার পূর্বাভাস ও গণনা

উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য জোয়ার ভাটার সময় এবং উচ্চতা আগে থেকে জানা খুবই দরকারি। বিজ্ঞানীরা জটিল গাণিতিক মডেল এবং দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ব্যবহার করে জোয়ার ভাটার পূর্বাভাস দেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভূমিকা এখানে মুখ্য। চাঁদ ও সূর্যের অবস্থান এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতিবিধির উপর ভিত্তি করে এই পূর্বাভাস তৈরি হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই জ্যোতির্বলয়গুলির ভবিষ্যৎ অবস্থান নিখুঁতভাবে গণনা করতে পারেন।

বহু বছর ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং জোয়ার ভাটার সময়কাল রেকর্ড করা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক তথ্য ভবিষ্যৎ পূর্বাভাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে। বিভিন্ন স্থানে জোয়ার ভাটার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, যা এই দীর্ঘমেয়াদী ডেটা থেকে বোঝা যায়।

আধুনিককালে জটিল গাণিতিক মডেল ও অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে জোয়ার ভাটার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এই মডেলগুলোতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনা, ঐতিহাসিক তথ্য, স্থানীয় ভূখণ্ড এবং আবহাওয়ার প্রভাব—সবকিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়। স্যাটেলাইট ডেটা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিমাপকারী যন্ত্র ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বাড়াতে সাহায্য করে।

জোয়ার ভাটার পূর্বাভাস নৌ চলাচলকে নিরাপদ করে, মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার পরিকল্পনায় সাহায্য করে, উপকূলীয় নির্মাণ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সহায়ক হয়।

পৃথিবীর উপর জোয়ার ভাটার প্রভাব

জোয়ার ভাটা কেবল একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, এটি পৃথিবীর পরিবেশ এবং মানুষের কার্যকলাপের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে।

নৌ চলাচল ও বন্দর: জোয়ারের সময় গভীরতা বাড়লে বড় জাহাজগুলো বন্দরে ঢুকতে ও বের হতে পারে। ভাটার সময় অগভীর হয়ে গেলে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। তাই, বন্দরের কাজকর্ম জোয়ার ভাটার সময়সূচীর উপর নির্ভরশীল।

মৎস্য শিকার: অনেক মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী জোয়ারের স্রোতের সাথে উপকূলের কাছাকাছি আসে, যা মৎস্যজীবীদের জন্য মাছ ধরা সহজ করে তোলে। ভাটার সময় অগভীর অঞ্চলে আটকা পড়া মাছ ধরাও একটি কৌশল।

উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান: জোয়ার ভাটা লবণাক্ত জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ বনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানকে প্রভাবিত করে। এটি লোনা জলের আনাগোনা, পুষ্টি সরবরাহ এবং বর্জ্য অপসারণে ভূমিকা রাখে, যা এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার জন্য জরুরি।

জোয়ারভাটা শক্তি: জোয়ার ভাটার নিয়মিত জলের প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। জোয়ারভাটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র জোয়ারের শক্তিকে টারবাইনের মাধ্যমে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যা একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে।

ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন: দীর্ঘমেয়াদী জোয়ার ভাটার প্রভাবে উপকূলীয় ভূমিক্ষয় ও পলল সঞ্চয় হতে পারে, যা উপকূলরেখার আকার পরিবর্তন করতে পারে। শক্তিশালী জোয়ারের স্রোত পাথর ও মাটিকে স্থানান্তরিত করতে সক্ষম।

জোয়ার ভাটা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় পরিবেশের উপর একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

অন্যান্য গ্রহে জোয়ার ভাটা

পৃথিবীর মতো সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহেও জোয়ার ভাটার ধারণা রয়েছে, যদিও এর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতে পারে।

বৃহস্পতি ও শনির উপগ্রহ: বৃহস্পতি ও শনির মতো গ্যাস জায়ান্ট গ্রহগুলোর শক্তিশালী মহাকর্ষ তাদের বড় উপগ্রহগুলোতে জোয়ার সৃষ্টি করে। যেমন, বৃহস্পতির উপগ্রহ আইও-তে শক্তিশালী জোয়ারের কারণে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখা যায়।

অন্যান্য উপগ্রহ: অন্যান্য গ্রহের উপগ্রহগুলোতেও তাদের গ্রহের আকর্ষণের কারণে জোয়ার প্রভাব ফেলে। এই জোয়ারগুলো উপগ্রহের ভেতরের গঠন ও কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে।

পৃথিবীর চাঁদ: পৃথিবীর চাঁদেও পৃথিবীর মহাকর্ষের কারণে জোয়ার প্রভাব বিদ্যমান। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই জোয়ারের কারণেই চাঁদ ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

বিভিন্ন গ্রহ ও উপগ্রহের জোয়ারের তীব্রতা নির্ভর করে গ্রহ ও উপগ্রহের ভর, তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং উপগ্রহের উপাদানের উপর। পৃথিবীর জোয়ার মূলত তরল জলের উপর কাজ করে, যেখানে অন্য গ্রহে কঠিন শিলা বা বরফের উপরও জোয়ার প্রভাব ফেলতে পারে। মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে জোয়ার ভাটা একটি সার্বজনীন ঘটনা।

আকর্ষণীয় তথ্য ও মিথ

জোয়ার ভাটা একটি রহস্যময় ও শক্তিশালী প্রাকৃতিক ঘটনা হওয়ায় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি নিয়ে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য ও লোককথা প্রচলিত আছে।

কানাডার ফানডি উপসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু জোয়ার দেখা যায়, যেখানে জোয়ারের উচ্চতা ১৬ মিটারেরও বেশি হতে পারে। এর কারণ হলো উপসাগরের বিশেষ ফানেল আকৃতি।

প্রাচীন সংস্কৃতিতে জোয়ার ভাটাকে সমুদ্র দেবতার শ্বাস-প্রশ্বাস বা অন্য কোনো রহস্যময় শক্তির কাজ মনে করা হতো। চাঁদের সাথে এর সম্পর্ক অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়েছে।

কিছু নদীতে, জোয়ারের জল একটি উঁচু ঢেউয়ের আকারে নদীর উজানে প্রবাহিত হয়, যাকে জোয়ার তরঙ্গ বলে। অ্যামাজান নদীর পোড়োরোকা ও ইংল্যান্ডের সেভার্ন নদীতে এটি দেখা যায়।

অনেক সামুদ্রিক প্রাণী প্রজনন ও খাদ্যের জন্য জোয়ার ভাটার উপর নির্ভরশীল। কিছু প্রাণী নির্দিষ্ট জোয়ারের সময় ডিম পাড়ে বা শিকার করে। জোয়ার ভাটা কেবল একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়, এটি মানব সংস্কৃতি ও প্রকৃতির বিস্ময়ের প্রতি আমাদের কৌতূহলও জাগিয়ে তোলে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জোয়ার ভাটার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেও হুমকির মুখে ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে জোয়ার ভাটার চরিত্রে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতাও বাড়বে, উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি বাড়বে ও নিচু এলাকা তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। বর্ধিত জোয়ারের ঢেউ উপকূলীয় ভূমিক্ষয় আরও বাড়িয়ে দেবে এবং লবণাক্ত জল কৃষি জমি ও মিষ্টি জলের উৎসকে দূষিত করতে পারে।

জোয়ার ভাটার পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানও সমস্যায় পড়বে। অনেক প্রজাতি তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল হারাতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা, বন্যাপ্রবণ এলাকায় সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যাবশ্যক। জোয়ার ভাটার চিরাচরিত ছন্দ আজ এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখ

উপসংহার: প্রকৃতির এই রহস্য ও গুরুত্ব

জোয়ার ভাটা কেন হয়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা মহাকর্ষীয় আকর্ষণ, পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং অন্যান্য বহুবিধ কারণের জটিল interplay-এর সন্ধান পেলাম। প্রকৃতির এই নিয়মিত ছন্দ আমাদের গ্রহের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনযাত্রার উপর এক গভীর প্রভাব ফেলে। জোয়ারের প্রকারভেদ, এর পূর্বাভাস এবং পৃথিবীর উপর এর প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সুরক্ষা ও সামুদ্রিক কার্যকলাপের পরিকল্পনায় সহায়ক। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে জোয়ার ভাটার আচরণে যে পরিবর্তন আসতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রকৃতির এই রহস্যময় ও শক্তিশালী ঘটনাটিকে বোঝা এবং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রশ্নোত্তর (FAQ)

  • জোয়ার ভাটা কি? সমুদ্র ও নদীর জলের নিয়মিত ও পর্যায়ক্রমিক ওঠানামাকে জোয়ার ভাটা বলে। এটি মূলত চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে ঘটে।
  • জোয়ার ভাটা কতক্ষণ স্থায়ী হয়? একটি পূর্ণ জোয়ার-ভাটা চক্র সাধারণত প্রায় ১২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এর কারণ হলো চাঁদের কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময়।
  • সবচেয়ে শক্তিশালী জোয়ার কোথায় দেখা যায়? কানাডার ফানডি উপসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জোয়ার দেখা যায়, যেখানে জোয়ারের উচ্চতা ১৬ মিটারেরও বেশি হতে পারে।
  • মরা কোটাল কখন হয়? যখন চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সাথে সমকোণে অবস্থান করে (প্রথম ও তৃতীয় চতুর্থাংশের সময়), তখন মরা কোটাল হয়। এই সময় জোয়ারের তীব্রতা কম থাকে।
  • জোয়ার ভাটা কি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহায্য করে? হ্যাঁ, জোয়ার ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। জোয়ারভাটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে জোয়ারের জলের গতিকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।

জোয়ার ভাটা কেন হয় : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top