ইসলামে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম, যা মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। এই জ্ঞান অর্জনের পথে আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ অপরিহার্য। জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া (দোয়া) সেই ঐশ্বরিক সাহায্যের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। এটি কেবল কিছু আরবি শব্দ উচ্চারণ নয়, বরং আল্লাহর সমীপে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও স্মরণশক্তির ঐকান্তিক প্রার্থনা।
এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়ার তাৎপর্য, অপরিহার্যতা এবং এর শক্তিশালী প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমরা জানব, কেন জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া জরুরি এবং এই দোয়ার ফজিলত ও কার্যকারিতা কী। শুধু তাই নয়, কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত জ্ঞান বৃদ্ধির সর্বাধিক পরিচিত ও শক্তিশালী দোয়াগুলো অর্থ, উৎস ও ফজিলতসহ তুলে ধরব।
এছাড়াও, জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া পাঠের সঠিক নিয়ম, আদব এবং সর্বোত্তম সময় সম্পর্কে আমরা অবগত হব। দোয়ার পাশাপাশি জ্ঞান, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক কিছু কার্যকরী আমল ও অভ্যাস নিয়েও আলোচনা করা হবে। ইসলামিক ইতিহাসে জ্ঞান সাধকদের জীবনে দোয়ার গুরুত্ব এবং জ্ঞানার্জন ও দোয়া বিষয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণার সংশোধনও এই প্রবন্ধে স্থান পাবে।
ইসলামে জ্ঞানের মর্যাদা এবং জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব
ইসলামে জ্ঞান (ইলম) শুধু তথ্য আহরণ নয়, বরং এটি একটি আলো যা মানুষকে সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শন করে, অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে। এটি এমন এক অপরিহার্য ইবাদত যার মাধ্যমে মানুষ নিজের এবং সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে।
ক. জ্ঞান কি এবং ইসলাম কেন জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছে? (কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি)
ইসলামী পরিভাষায় ‘ইলম’ বা জ্ঞান বলতে সেই معرفة (মা’রিফাহ) বা পরিচিতিকে বোঝায় যা আল্লাহর সত্তা, তাঁর গুণাবলী, তাঁর আদেশ-নিষেধ এবং সৃষ্টিজগত সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়। এই জ্ঞান মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এবং উপকারী-অপকারী বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়।
পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত আয়াতটিই ছিল জ্ঞানার্জন সম্পর্কিত:
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক্ব) “পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আলাক, আয়াত: ১)
এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ইসলামে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু তাই নয়, জ্ঞানার্জনকে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ বা অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন:
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ (তলাবুল ইলমি ফারীদাতুন ‘আলা কুল্লি মুসলিম) “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২২৪)
ইসলাম এমন জ্ঞানকে উৎসাহিত করে যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক এবং মানবতার জন্য কল্যাণকর।
খ. জ্ঞানী ও মূর্খের পার্থক্য: আল্লাহর দৃষ্টিতে জ্ঞানীর সম্মান
ইসলাম জ্ঞান এবং জ্ঞানীর মর্যাদাকে অত্যন্ত উঁচুতে স্থান দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানী এবং অজ্ঞদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেছেন:
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ (ক্বুল হাল ইয়াস্তাউইল্লাযীনা ইয়া’লামূনা ওয়াল্লাযীনা লা ইয়া’লামূন) “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?” (সূরা যুমার, আয়াত: ৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার এবং জ্ঞানীদের মর্যাদা সমুন্নত করার ঘোষণা দিয়েছেন:
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ (ইয়ারফা’ইল্লাহুল্লাযীনা আমানূ মিনকুম ওয়াল্লাযীনা ঊতুল ‘ইলমা দারাজ্বা-ত) “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ্ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন।” (সূরা মুজাদালা, আয়াত: ১১)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আবিদ (ইবাদতকারী) এর উপর আলিমের (জ্ঞানীর) মর্যাদা তেমন, যেমন তোমাদের সাধারণ লোকের উপর আমার মর্যাদা।” (সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং ২৬৮৫)। এর দ্বারা বোঝা যায়, সঠিক জ্ঞানভিত্তিক ইবাদত আল্লাহ তা’আলার নিকট অধিক প্রিয়।
গ. জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য: দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ
ইসলামে জ্ঞানার্জনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনা করা। এর মাধ্যমে একজন মুসলিম যেমন নিজের দুনিয়াবী জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করতে পারে, তেমনই আখিরাতের অনন্ত জীবনেও সাফল্য লাভ করতে পারে।
- আল্লাহর পরিচয় লাভ: ইলমের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি, তাঁর ক্ষমতা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, যা তার ঈমানকে দৃঢ় করে।
- সঠিক ইবাদত পালন: জ্ঞান ছাড়া সঠিকভাবে ইবাদত করা সম্ভব নয়। কোনটি হালাল, কোনটি হারাম, কোনটি ফরজ, কোনটি সুন্নত – এগুলো জানতে হলে ইলমের প্রয়োজন।
- মানবতার কল্যাণ: অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও বৃহত্তর মানবতার সেবা করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
- জান্নাতের পথ সুগম করা: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৯৯)
তবে, যে জ্ঞান অহংকার সৃষ্টি করে বা মানুষের ক্ষতিসাধনে ব্যবহৃত হয়, ইসলাম সে জ্ঞানকে নিরুৎসাহিত করে। উপকারী জ্ঞানই কাম্য।
ঘ. কেন জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন? (প্রচেষ্টার পাশাপাশি দোয়ার ভূমিকা)
মানুষের সকল সক্ষমতা, মেধা, প্রজ্ঞা এবং স্মরণশক্তি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দান। একজন শিক্ষার্থী বা জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি যতই চেষ্টা করুক না কেন, আল্লাহর তাওফীক বা অনুগ্রহ ছাড়া জ্ঞানার্জন এবং তা আয়ত্তে রাখা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা’আলা যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন:
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا (ইউ’তিল হিকমাতা মাইঁ ইয়াশা। ওয়ামাইঁ ইউ’তাল হিকমাতা ফাক্বাদ ঊতিয়া খাইরান কাছীরা) “তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)
তাই, জ্ঞানার্জনের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে সাহায্য প্রার্থনা করা, অর্থাৎ দোয়া করা অপরিহার্য। দোয়া হলো প্রচেষ্টার পরিপূরক এবং এতে বরকত লাভের মাধ্যম। দোয়া মানুষের বিনয় প্রকাশ করে এবং আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা বাড়ায়, যা জ্ঞান লাভের অন্যতম শর্ত।
‘দোয়া’ কি? জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়ার অপরিহার্যতা ও শক্তি
‘দোয়া’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ডাকা, আহ্বান করা, প্রার্থনা করা বা কোনো কিছু চাওয়া। ইসলামী পরিভাষায়, দোয়া হলো বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর সমীপে নিজের প্রয়োজন, আকুতি ও মিনতি পেশ করার একটি মাধ্যম এবং গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
ক. দোয়ার আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
- আভিধানিক অর্থ: দোয়া (الدعاء) শব্দটি دعو (দা’ওয়া) মূলধাতু থেকে উদ্ভূত, যার একাধিক অর্থ রয়েছে, যেমন – ডাকা (to call), প্রার্থনা করা (to supplicate), আহ্বান করা (to invoke), কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট করা বা কোনো কিছুর দিকে ধাবিত হওয়া।
- পারিভাষিক অর্থ: শরীয়তের পরিভাষায়, দোয়া হলো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অথবা সাধারণভাবে আল্লাহর নিকট কোনো কল্যাণ লাভ বা অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা। এটি বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এতে বান্দা নিজের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।
জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করা মানে হলো, আল্লাহ তা’আলার কাছে বিশেষভাবে এই আরজি পেশ করা যেন তিনি আমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুঝ এবং স্মরণশক্তি বাড়িয়ে দেন ও অর্জিত জ্ঞানকে কল্যাণকর করেন।
খ. দোয়া একটি স্বতন্ত্র ইবাদত: এর ফজিলত ও গুরুত্ব
দোয়া শুধু প্রয়োজনে চাওয়ার মাধ্যমই নয়, বরং এটি নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন:
الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ (আদ-দু’আউ হুয়াল ‘ইবাদাহ) “দোয়াই হলো ইবাদত।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৮২৮)
এই হাদিস থেকে দোয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। দোয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও নিজের দাসত্বকে স্বীকার করে নেয়। এর ফজিলত অপরিসীম:
- আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়।
- আল্লাহ তা’আলা দোয়াকারীর উপর সন্তুষ্ট হন।
- বিপদ-আপদ দূর হয়।
- অর্জিত বিষয়ে বরকত লাভ হয়।
- অন্তর প্রশান্ত হয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হন। তাই, জ্ঞান বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা একান্ত জরুরি।
গ. ভাগ্য পরিবর্তনে দোয়ার প্রভাব (ইসলামিক দৃষ্টিকোণ)
ভাগ্য বা তাকদীর আল্লাহ তা’আলার পূর্বনির্ধারিত বিষয়। তবে, ইসলামে দোয়ার এমন শক্তি রয়েছে যা তাকদীরের কিছু বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
لَا يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلَّا الدُّعَاءُ (লা ইয়ারুদ্দুল ক্বাদ্বা-আ ইল্লাদ দু’আ) “দোয়া ব্যতীত আর কিছুই (তাকদীরের) সিদ্ধান্তকে রদ করতে পারে না।” (সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং ২১৩৯)
এর ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেন, কিছু তাকদীর শর্তসাপেক্ষ (মুআল্লাক) থাকে, যা দোয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে। আবার কিছু তাকদীর চূড়ান্ত (মুবরাম), যা পরিবর্তিত হয় না, তবে দোয়ার বরকতে আল্লাহ তা’আলা সেই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার শক্তি দান করেন অথবা তার বিনিময়ে অন্য কোনো কল্যাণ দান করেন।
জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও দোয়া আমাদের প্রচেষ্টায় বরকত এনে দিতে পারে, কঠিন বিষয় সহজ করে দিতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে শেখার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে – যা প্রকারান্তরে আমাদের জ্ঞান সম্পর্কিত ভাগ্যকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
ঘ. জ্ঞানার্জন ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে দোয়ার কার্যকারিতা: কিভাবে কাজ করে?
দোয়া সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভের একটি মাধ্যম। যখন কোনো ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে জ্ঞান বা স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য দোয়া করে, তখন আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে পারেন:
- তাওফীক (সক্ষমতা) দান: আল্লাহ তার জন্য জ্ঞানার্জনের পথ সহজ করে দেন, সঠিক শিক্ষক ও উপকরণের ব্যবস্থা করে দেন।
- হৃদয় উন্মোচন: তার অন্তরকে জ্ঞানের আলো গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন, ফলে সে জটিল বিষয়ও সহজে বুঝতে পারে।
- স্মৃতিশক্তি প্রখরকরণ: আল্লাহ তার স্মরণশক্তিকে শক্তিশালী করে দেন, যেন সে অর্জিত জ্ঞান ধরে রাখতে পারে।
- মনোযোগ বৃদ্ধি: পড়ালেখা বা জ্ঞানচর্চার সময় শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করেন, ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
- অলসতা দূরীকরণ: জ্ঞানার্জনের পথে যে আলস্য বা প্রতিবন্ধকতা আসে, দোয়া তা দূর করতে সাহায্য করে।
- বরকত দান: অল্প প্রচেষ্টায় অধিক ফল লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
মূলত, দোয়া হলো আল্লাহর অসীম রহমত ও সাহায্যের ভাণ্ডার থেকে নিজের জন্য কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। জ্ঞানার্জনের মতো মহৎ কাজে এই সাহায্য অত্যাবশ্যক।
কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত জ্ঞান বৃদ্ধির সর্বাধিক পরিচিত ও শক্তিশালী দোয়া সমূহ
ইসলাম জ্ঞানান্বেষণের যাত্রায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার জন্য বেশ কিছু সুন্দর ও শক্তিশালী দোয়া শিক্ষা দিয়েছে। এগুলো সরাসরি কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত। নিম্নে সর্বাধিক পরিচিত ও কার্যকর কিছু দোয়া বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক. “রাব্বি যিদনী ইলমা” (رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا): অর্থ, উৎস ও ফজিলত
- আরবিতে দোয়া:
رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا - উচ্চারণ:
রাব্বি যিদনী ‘ইলমা। - অর্থ:
“হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” - উৎস:
এই দোয়াটি পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বোয়া-হা এর ১১৪ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এই দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। আয়াতের পূর্ণ অংশ: فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ ۗ وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِن قَبْلِ أَن يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا “সুতরাং সর্বোচ্চ মর্যাদাবান আল্লাহই সত্যিকারের বাদশাহ। আর আপনার প্রতি আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আপনি কুরআন পাঠে তাড়াহুড়া করবেন না এবং বলুন, ‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’।” - ফজিলত ও প্রেক্ষাপট:
এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কেও জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে। এটি সব ধরনের উপকারী জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য একটি ব্যাপক ও সংক্ষিপ্ত দোয়া। জ্ঞানার্জনের প্রতিটি পর্যায়ে, নতুন কিছু শেখার আগে বা অধ্যয়নের সময় এই দোয়া পাঠ করা অত্যন্ত উপকারী। এটি শুধু একাডেমিক জ্ঞানই নয়, বরং আল্লাহর পরিচয়, দ্বীনের সঠিক বুঝ এবং প্রজ্ঞার জন্যও প্রযোজ্য। এর নিয়মিত পাঠ জ্ঞান লাভের আগ্রহ ও একাগ্রতা বাড়ায়।
খ. “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি’আ…” (اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا…): সম্পূর্ণ দোয়া, অর্থ ও প্রেক্ষাপট
- আরবিতে সম্পূর্ণ দোয়া:
” اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا، وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا” - উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ‘ইলমান না-ফি’আ, ওয়া রিযক্বান ত্বাইয়্যিবা, ওয়া ‘আমালাম মুতাক্বাব্বালা। - অর্থ:
“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট উপকারী জ্ঞান, পবিত্র জীবিকা এবং গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।” - উৎস ও প্রেক্ষাপট:
এই দোয়াটি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের নামাজের পর এই দোয়াটি পাঠ করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৯২৫; মুসনাদে আহমাদ) এই দোয়ায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাওয়া হয়েছে: - ১. উপকারী জ্ঞান (‘ইলমান নাফি’আ): এমন জ্ঞান যা দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনে, যা ব্যক্তিকে আল্লাহর অনুগত করে এবং মানবতার সেবায় লাগে।
- ২. পবিত্র জীবিকা (রিযক্বান ত্বাইয়্যিবা): হালাল ও উত্তম জীবিকা, যা ইবাদত কবুলের শর্ত এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য জরুরি।
- ৩. গ্রহণযোগ্য আমল (‘আমালাম মুতাক্বাব্বালা): এমন কাজ বা ইবাদত যা আল্লাহ তা’আলার নিকট কবুল হয়, অর্থাৎ ইখলাস ও সুন্নাহ মোতাবেক সম্পাদিত হয়। প্রতিদিন সকালে এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে দিনের শুরুতেই আল্লাহর কাছে এই মৌলিক বিষয়গুলো প্রার্থনা করা হয়, যা জ্ঞানার্জন ও জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ. “সুবহানাকা লা ইলমা লানা ইল্লা মা আল্লামতানা…” (سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا…): অর্থ, কখন পড়বেন?
- আরবিতে সম্পূর্ণ দোয়া:
” سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ” - উচ্চারণ:
সুবহা-নাকা লা ‘ইলমা লানা ইল্লা মা ‘আল্লামতানা~, ইন্নাকা আনতাল ‘আলীমুল হাকীম। - অর্থ:
“(তারা বলল) আপনি পবিত্র! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের তো অন্য কোনো জ্ঞানই নেই। নিশ্চয়ই আপনিই সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” - উৎস ও প্রেক্ষাপট:
এই আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা এর ৩২ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এটি ছিল ফেরেশতাদের উক্তি, যখন আল্লাহ তা’আলা আদম (আঃ)-কে কিছু নাম শিক্ষা দেওয়ার পর ফেরেশতাদেরকে সেই নামগুলো বলতে বললেন এবং তারা অপারগতা প্রকাশ করে এই কথাগুলো বলেছিলেন। - কখন পড়বেন ও তাৎপর্য:
এই দোয়াটি মূলত আল্লাহর সামনে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং তাঁর অসীম জ্ঞানের প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের বহিঃপ্রকাশ। যখন কোনো জটিল বিষয়ে জ্ঞান বা বোঝার অভাব অনুভূত হয়, কোনো আলোচনার শুরুতে, অথবা যখন কোনো কিছু শেখার বা বোঝার চেষ্টা করা হয়, তখন এই দোয়া পাঠ করা যেতে পারে। এটি বিনয় সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান লাভের পথ উন্মুক্ত করে। এটি দ্বারা স্বীকার করা হয় যে, প্রকৃত জ্ঞানের উৎস একমাত্র আল্লাহ তা’আলা।
ঘ. “আল্লাহুম্মা ইনফ্য়ানী বিমা আল্লামতানী…” (اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي…): সম্পূর্ণ দোয়া, অর্থ ও উৎস
- আরবিতে সম্পূর্ণ দোয়া:
اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي، وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي، وَزِدْنِي عِلْمًا - উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মানফা’নী বিমা ‘আল্লামতানী, ওয়া ‘আল্লিমনি মা ইয়ানফা’উনী, ওয়া যিদনী ‘ইলমা। - অর্থ:
“হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তার দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন। আর যা আমার উপকারে আসবে, তা আমাকে শিক্ষা দিন এবং আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” - উৎস:
এই দোয়াটিও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই দোয়া করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। (সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং ৩৫৯৯) - তাৎপর্য:
এই দোয়ায় তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরজি রয়েছে: ১. অর্জিত জ্ঞান যেন উপকারী হয়, অর্থাৎ তা যেন শুধু তথ্য হিসেবে মাথায় না থেকে বাস্তব জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে। ২. আল্লাহ যেন এমন নতুন জ্ঞান দান করেন যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। ৩. সামগ্রিকভাবে ইলম বা জ্ঞান যেন বৃদ্ধি পায়। এটি একটি جامع (জামে) বা সমন্বিত দোয়া যা জ্ঞানার্জনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল স্তরের জন্য প্রযোজ্য।
ঙ. অন্যান্য প্রাসঙ্গিক দোয়া ও যিকির (স্মরণশক্তি ও বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য)
উপরে উল্লেখিত দোয়াগুলো ছাড়াও আরো কিছু সাধারণ দোয়া ও যিকির রয়েছে যা জ্ঞান, বুঝ এবং স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে:
- দরুদ শরীফ পাঠ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা অনেক কঠিন বিষয় সহজ করে দেন এবং অন্তরে প্রশান্তি দান করেন, যা জ্ঞান ধারণের জন্য সহায়ক।
- ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা): অধিক পরিমাণে “আস্তাগফিরুল্লাহ” পাঠ করলে অন্তর পরিষ্কার হয়। অন্তরের পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) একবার তাঁর উস্তাদ ওয়াকী (রহঃ)-এর নিকট স্মরণশক্তি দুর্বলতার অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে গুনাহ পরিত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছিলেন, কারণ আল্লাহর নূর (জ্ঞান) কোনো গুনাহগারকে দেওয়া হয় না।
- “লা হাওলা ওয়ালা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”: (আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো কিছুই করার বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই) – এই যিকির পাঠ করলে কঠিন কাজ সহজ হয় এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা বাড়ে।
- নির্দিষ্ট সময় দোয়া করা: যেমন, পড়া শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” বলা এবং পড়া শেষে “আলহামদুলিল্লাহ” বলা।
এসব দোয়া ও যিকির নিয়মিত আমলের অংশ করে নিলে ইনশাআল্লাহ জ্ঞানার্জন ও তা ধারণ করা সহজ হবে।
জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া পাঠের সঠিক নিয়ম, আদব ও সর্বোত্তম সময়
দোয়া আল্লাহর কাছে বান্দার আরজি পেশ করার মাধ্যম। এই আরজি পেশ করার কিছু নিয়ম ও আদব রয়েছে যা পালন করলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া পাঠের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো প্রযোজ্য।
ক. দোয়া কবুলের আবশ্যিক শর্তাবলী
দোয়া কবুল হওয়ার জন্য কিছু মৌলিক শর্ত রয়েছে, যা পূরণ হওয়া বাঞ্ছনীয়:
- ইখলাস (একনিষ্ঠতা): একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দোয়া করা, লোক দেখানো বা অন্য কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে নয়।
- আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস (ইয়াকিন): এই বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ অবশ্যই দোয়া শোনেন এবং তিনি কবুল করতে সক্ষম। দ্বিধা বা সংশয় নিয়ে দোয়া না করা।
- হালাল উপার্জন ও খাদ্য: হারাম উপার্জন বা খাদ্য গ্রহণ দোয়া কবুলের পথে বড় অন্তরায়। শরীর ও পোশাক পবিত্র ও হালাল হতে হবে।
- গুনাহ থেকে বিরত থাকা: বড় বড় গুনাহ এবং অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
- দোয়ায় তাড়াহুড়া না করা: দোয়া করেই ফল পাওয়ার জন্য অধৈর্য না হওয়া। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয়, যতক্ষণ সে তাড়াহুড়া না করে…” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৩৪০)।
- আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত।
- নিষিদ্ধ বিষয়ে দোয়া না করা: কোনো অন্যায়, গুনাহের কাজ বা কারো ক্ষতির জন্য দোয়া না করা।
খ. দোয়া পাঠের মুস্তাহাব নিয়মাবলী (আদব)
কিছু আদব বা মুস্তাহাব নিয়ম রয়েছে যা পালন করলে দোয়া আরো সুন্দর ও কার্যকর হয়:
- ওযু করা: সম্ভব হলে ওযু অবস্থায় দোয়া করা উত্তম।
- কিবলামুখী হওয়া: দোয়ার সময় কিবলামুখী হয়ে বসা।
- আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ: দোয়ার শুরুতে আল্লাহর হামদ (প্রশংসা) ও সানা (গুণগান) করা এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা। দোয়ার শেষেও দরুদ পাঠ করা উত্তম।
- হাত তুলে দোয়া করা: বিনয়ের সাথে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করা।
- মিনতি ও কাকুতি সহকারে দোয়া করা: অন্তরের গভীর থেকে ভয় ও আশা নিয়ে দোয়া করা।
- গোপনে দোয়া করা: লোকচক্ষুর আড়ালে বা নীরবে দোয়া করা অধিক ইখলাসের পরিচায়ক, যদিও সম্মিলিতভাবে দোয়া করাও জায়েজ।
- নিজের গুনাহের স্বীকারোক্তি: দোয়ার মধ্যে নিজের ভুলত্রুটি ও গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
- দোয়া তিনবার করা: কোনো কোনো বর্ণনায় তিনবার দোয়া করার কথা এসেছে।
- অন্যান্য মুমিনদের জন্য দোয়া করা: নিজের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং সকল মুমিন নর-নারীর জন্য দোয়া করা।
গ. দোয়া করার উত্তম সময়সমূহ
কিছু বিশেষ সময় ও অবস্থায় দোয়া কবুলের অধিক সম্ভাবনা থাকে। জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করার ক্ষেত্রেও এই সময়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে:
- রাতের শেষ তৃতীয়াংশ (তাহাজ্জুদের সময়): যখন আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দাদের আহ্বান করতে থাকেন।
- আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়: এই সময়ের দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না।
- ফরজ নামাজের পর: বিশেষ করে সালাম ফেরানোর আগে (তাশাহহুদ ও দরুদের পর) অথবা সালাম ফেরানোর পর।
- জুম্মার দিন: বিশেষ করে ইমামের খুতবায় বসা থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে যখন দোয়া কবুল হয়।
- লাইলাতুল কদর (কদরের রাত্রি): এই রাতের ইবাদত ও দোয়া হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
- সেজদারত অবস্থায়: বান্দা যখন সেজদায় থাকে, তখন সে আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। তাই সেজদায় বেশি বেশি দোয়া করা উচিত।
- বৃষ্টি বর্ষণের সময়: বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয় বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
- সিয়াম (রোজা) অবস্থায়: বিশেষ করে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে রোজাদারের দোয়া কবুল হয়।
- আরাফাতের ময়দানে (হজ্জের সময়): আরাফাতের দিনের দোয়া শ্রেষ্ঠ দোয়া।
এই সময়গুলোতে একাগ্রতার সাথে জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে আশা করা যায়।
ঘ. দোয়ায় একাগ্রতা ও ইয়াকিন (বিশ্বাস) ধরে রাখার উপায়
একাগ্রতা ও ইয়াকিন দোয়ার প্রাণ। এগুলো ছাড়া দোয়া নিছক শব্দ উচ্চারণে পর্যবসিত হয়। এগুলো অর্জনের কিছু উপায়:
- দোয়ার অর্থ অনুধাবন: যে দোয়াটি পাঠ করা হচ্ছে, তার অর্থ ও তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করা।
- আল্লাহর মহত্ত্ব ও ক্ষমতার স্মরণ: আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান এবং তিনি সবকিছু করতে পারেন, এই বিশ্বাস অন্তরে জাগ্রত রাখা।
- দুনিয়াবী চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া: দোয়ার সময় পার্থিব সকল ব্যস্ততা ও চিন্তা থেকে মনকে যথাসম্ভব দূরে রাখা।
- আল্লাহর রহমতের আশা রাখা: নিরাশ না হয়ে আল্লাহর অসীম রহমত ও করুণার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা।
- সবর (ধৈর্য) ধারণ: দোয়া কবুল হতে বিলম্ব হলেও ধৈর্য ধারণ করা এবং দোয়া চালিয়ে যাওয়া।
- গুনাহ পরিহার: গুনাহের কারণে অন্তরে যে কালিমা পড়ে, তা একাগ্রতা নষ্ট করে। তাই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।
- দোয়া কবুলের নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করা: অতীতে আল্লাহ কীভাবে আপনার বা অন্যের দোয়া কবুল করেছেন, তা স্মরণ করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাস বাড়ানো।
নিয়মিত এই অনুশীলনগুলো চালিয়ে গেলে দোয়ায় একাগ্রতা ও ইয়াকিন বৃদ্ধি পাবে, ইনশাআল্লাহ।
দোয়ার পাশাপাশি জ্ঞান, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক কার্যকরী আমল ও অভ্যাস
জ্ঞান, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধির জন্য শুধু দোয়ার উপর নির্ভর করে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং, দোয়ার সাথে সাথে সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা, আমল ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা অপরিহার্য। ইসলাম এই সমন্বিত পদ্ধতিকেই উৎসাহিত করে। নিম্নে এমন কিছু কার্যকরী আমল ও অভ্যাসের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
ক. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থসহ অধ্যয়ন
পবিত্র কুরআন হলো সকল জ্ঞানের মূল উৎস এবং মানবজাতির জন্য হেদায়েত।
- তিলাওয়াতের বরকত: নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করলে অন্তরে প্রশান্তি আসে, শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তি মেলে এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা কুরআন পাঠ করো। কেননা, কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকদের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আগমন করবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৮০৪)
- অর্থ ও তাফসীর অধ্যয়ন: শুধু তিলাওয়াত নয়, কুরআনের অর্থ ও তাফসীর (ব্যাখ্যা) অধ্যয়ন করলে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়, আল্লাহর মহত্ত্ব উপলব্ধি করা যায় এবং জীবন পরিচালনার সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এটি বোধশক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ায়।
- মুখস্থকরণ: কুরআনের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করা (হিফয) স্মৃতিশক্তি উন্নয়নের একটি পরীক্ষিত ও অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম।
খ. হাদিস অধ্যয়ন ও ইসলামিক বই পাঠ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদিস হলো কুরআনের বাস্তব ব্যাখ্যা এবং জীবন পরিচালনার আদর্শ নমুনা।
- হাদিস পাঠের গুরুত্ব: হাদিস অধ্যয়নের মাধ্যমে সুন্নাহ সম্পর্কে জানা যায়, যা দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের জন্য অপরিহার্য। এটি ফিকহ (ইসলামী আইন), আখলাক (চরিত্র) এবং জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।
- ইসলামিক স্কলারদের বই: নির্ভরযোগ্য আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের লেখা বইপত্র পাঠ করলে দ্বীনের গভীর জ্ঞান লাভ করা যায়, বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা জন্মে এবং চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয়।
গ. শিক্ষকদের সম্মান করা ও তাদের জন্য দোয়া করা
জ্ঞানার্জনের পথে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
- শিক্ষকের প্রতি আদব: শিক্ষকের সাথে নম্র আচরণ করা, তাদের নির্দেশনা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তা পালন করার চেষ্টা করা।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: শিক্ষকের অবদানের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। হযরত আলী (রাঃ) বলতেন, “যে আমাকে একটি অক্ষর শিক্ষা দিয়েছে, আমি তার গোলাম।”
- এই সম্মান ও দোয়ার বরকতে অর্জিত জ্ঞানে আল্লাহ তা’আলা বরকত দান করেন।
ঘ. অর্জিত জ্ঞান লেখা ও অন্যকে শেখানো (জ্ঞান চর্চা)
জ্ঞানকে স্থায়ী ও কার্যকরী করার অন্যতম সেরা উপায় হলো তা লিখে রাখা এবং অন্যকে শিক্ষা দেওয়া।
- লিখে রাখার উপকারিতা: অর্জিত বিষয় লিখে রাখলে তা স্মৃতিতে ভালোভাবে গেঁথে যায় এবং পরবর্তীতে তা পর্যালোচনা করতে সুবিধা হয়।
- জ্ঞান বিতরণের ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে তা শিক্ষা দেয়।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫০২৭)। অন্যকে শেখানোর মাধ্যমে নিজের জ্ঞান আরও পরিষ্কার ও পাকাপোক্ত হয়। এটি জ্ঞানের যাকাতও বটে।
- আলোচনা ও পর্যালোচনা: সহপাঠী বা জ্ঞানীদের সাথে অর্জিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয় এবং বুঝ গভীর হয়।
ঙ. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা (বিশেষ করে চোখের গুনাহ)
গুনাহ বা পাপकार्य অন্তরের স্বচ্ছতাকে নষ্ট করে এবং আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যা জ্ঞান লাভের পথে বড় অন্তরায়।
- অন্তরের উপর পাপের প্রভাব: ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) তাঁর বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন, “আমি আমার উস্তাদ ওয়াকীর কাছে আমার স্মরণশক্তি দুর্বলতার অভিযোগ করেছিলাম। তিনি আমাকে গুনাহ পরিত্যাগ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। কেননা, আল্লাহর জ্ঞান হলো নূর, আর আল্লাহর নূর কোনো গুনাহগারকে দেওয়া হয় না।”
- চোখের হেফাজত: বিশেষভাবে চোখের গুনাহ (যেমন: হারাম দৃষ্টি) স্মৃতিশক্তি ও মেধার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই দৃষ্টিকে সংযত রাখা জরুরি।
- অন্যান্য গুনাহ থেকে সতর্কতা: মিথ্যা, গীবত, অহংকার ইত্যাদি সকল প্রকার ছোট-বড় গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা।
চ. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: ঘুম, খাদ্য ও বিশ্রাম
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা জ্ঞানার্জন এবং তা ধারণ করার জন্য অপরিহার্য। ইসলাম এ বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়।
- পর্যাপ্ত ঘুম: মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও স্মৃতিশক্তি ঠিক রাখার জন্য রাতের পরিমিত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। ইসলামে এশার পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো এবং ফজরের আগে ওঠার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
- সুষম ও হালাল খাদ্য: স্বাস্থ্যকর, হালাল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। অতিরিক্ত ভোজন পরিহার করা, কারণ তা অলসতা সৃষ্টি করে এবং মেধাকে স্থূল করে দেয়। কিছু খাবার যেমন – মধু, কালোজিরা, দুধ, খেজুর, বাদাম ইত্যাদি স্মৃতিশক্তি বর্ধক হিসেবে পরিচিত।
- শারীরিক পরিশ্রম ও বিশ্রাম: পরিমিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম শরীরকে সতেজ রাখে। পাশাপাশি, মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত চাপ থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত বিশ্রামও প্রয়োজন।
ছ. অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ পরিহার, সময়ের সদ্ব্যবহার
সময় আল্লাহর এক অমূল্য নিয়ামত। জ্ঞানার্জনের জন্য সময়ের সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- অপ্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ: যে কথা বা কাজ দুনিয়া বা আখিরাতের জন্য কল্যাণকর নয়, তা পরিহার করা। এতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
- লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা: জ্ঞানার্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে সময় ব্যয় করা।
- ধারাবাহিকতা বজায় রাখা: প্রতিদিন অল্প হলেও নিয়মিত অধ্যয়ন করা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৪৬৫)
এই আমল ও অভ্যাসগুলো দোয়ার সাথে যুক্ত হলে জ্ঞান, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করা সম্ভব, ইনশাআল্লাহ।
স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশে দোয়ার প্রভাব
মানুষের মেধা, বুদ্ধি ও স্মরণশক্তি আল্লাহ তা’আলার বিশেষ নিয়ামত। এই নিয়ামতগুলোর সঠিক বিকাশ ও স্থায়িত্বের জন্য চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ও সাহায্য অপরিহার্য। দোয়া বা প্রার্থনার মাধ্যমে এই সাহায্য লাভ করা যায়, যা মনোযোগ বৃদ্ধি, বিস্মৃতি হ্রাস এবং সামগ্রিকভাবে স্মৃতিশক্তি প্রখর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ক. মনোযোগ বৃদ্ধিতে দোয়ার ভূমিকা
মনোযোগ বা একাগ্রতা জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কোনো কিছু শেখা বা মনে রাখা অত্যন্ত কঠিন। দোয়া যেভাবে মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে:
- মানসিক প্রশান্তি ও স্থিরতা: যখন একজন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করে, তখন তার অন্তরে এক ধরনের সাকিনা বা প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। এই প্রশান্তি মানসিক অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা দূর করে, যা মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা’দ, আয়াত: ২৮)।
- শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সুরক্ষা: শয়তান সর্বদা মানুষকে ভালো কাজ থেকে বিরত রাখতে এবং তার মনোযোগ নষ্ট করতে চায়। দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়। “রাব্বি আ’উযুবিকা মিন হামাযা-তিশ শায়া-ত্বীন, ওয়া আ’উযুবিকা রাব্বি আইঁ ইয়াহদ্বুরূন” (হে আমার পালনকর্তা, আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে এবং হে আমার প্রভু, তাদের আমার কাছাকাছি আসা থেকেও আমি আপনার কাছে পরিত্রাণ চাইছি।) – এই জাতীয় দোয়া মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক।
- লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতা: দোয়ার মাধ্যমে যখন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে (যেমন জ্ঞানার্জন) আল্লাহর সাহায্য চাওয়া হয়, তখন সেই লক্ষ্যের প্রতি ব্যক্তির মানসিক সংযোগ দৃঢ় হয় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকে মনোযোগ সরে আসে।
খ. ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমাতে দোয়া
ভুলে যাওয়া মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তবে অতিরিক্ত বিস্মৃতি জ্ঞান ধারণের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। দোয়া এই সমস্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে:
- আল্লাহর কাছে স্মৃতিশক্তি প্রার্থনা: বিস্মৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরাসরি আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, وَإِنِّي يَا رَبِّ نَسِيتُ উচ্চারণ: “ওয়া ইন্নী ইয়া রাব্বি নাসীতু” বাংলা অর্থ: “হে আমার রব, আমি ভুলে গেছি।”– এই ধরনের অনুভূতি নিয়ে দোয়া করা।
- গুনাহ থেকে মুক্তি: অনেক সময় গুনাহের কারণে মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। ইস্তেগফার ও তওবার মাধ্যমে গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং ভবিষ্যতে গুনাহমুক্ত জীবনযাপনের চেষ্টা করলে আল্লাহ তা’আলা স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন।
- জ্ঞানের বরকত কামনা: অর্জিত জ্ঞানে আল্লাহর বরকত কামনা করা। যে জ্ঞানে বরকত থাকে, তা সহজে স্মৃতি থেকে মুছে যায় না এবং প্রয়োজনের সময় তা কাজে লাগে।
গ. আল্লাহর সাহায্যে স্মৃতিশক্তি প্রখর করার উপায়
স্মৃতিশক্তি মূলত আল্লাহরই দান। তাঁর সাহায্যেই এটি প্রখর ও স্থায়ী হতে পারে:
- তাকওয়া অবলম্বন: আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া অন্তরে ধারণ করলে আল্লাহ তা’আলা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন। কুরআনে আছে, “আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৮২)। তাকওয়ার ফলে অন্তর পরিষ্কার হয় এবং তা জ্ঞান ধারণের উপযোগী হয়।
- নিয়মিত যিকির ও কুরআন তিলাওয়াত: আল্লাহর যিকির, বিশেষ করে কুরআন তিলাওয়াত, অন্তরকে সজীব রাখে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: আল্লাহ যে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি দান করেছেন, তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা। শুকরিয়ার মাধ্যমে নিয়ামত বৃদ্ধি পায়।
- দোয়ায়ে ইউনুস পাঠ: “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যা-লিমীন” – এই দোয়া পাঠ করলে বিপদ-আপদ দূর হয় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে, যা স্মৃতিশক্তির জন্য সহায়ক।
মূলত, দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন হয় এবং তাঁর অসীম ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তির মতো নিয়ামত লাভের পথ সুগম হয়।
জ্ঞানার্জন ও দোয়ার বিষয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার সংশোধন
জ্ঞানার্জন ও এ সম্পর্কিত দোয়া নিয়ে মুসলিম সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এগুলোর সঠিক উপলব্ধি না থাকলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। নিম্নে এমন কিছু ভুল ধারণা ও তার ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংশোধন আলোচনা করা হলো:
ক. শুধু দোয়া করলেই হবে, চেষ্টা লাগবে না?
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করলেই যথেষ্ট, আর কোনো পরিশ্রম বা অধ্যয়নের প্রয়োজন নেই। দোয়া করলেই আল্লাহ সবকিছু সহজ করে দেবেন এবং জ্ঞান আপনাআপনি চলে আসবে।
সংশোধন: এটি ইসলামের “তাওয়াক্কুল” (আল্লাহর উপর ভরসা) এবং “আসবাব” (উপকরণ বা প্রচেষ্টা) গ্রহণের নীতির পরিপন্থী। ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, কোনো কিছু অর্জনের জন্য প্রথমে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে, প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে হবে এবং তারপর ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা (তাওয়াককুল) করতে হবে ও দোয়া করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতেন, বর্ম পরিধান করতেন, কৌশল অবলম্বন করতেন এবং এরপর আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। তিনি এক সাহাবীকে বলেছিলেন, “আগে উট বাঁধো, তারপর তাওয়াককুল করো।” (সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং ২৫১৭)।
সুতরাং, জ্ঞানার্জনের জন্য নিয়মিত অধ্যয়ন, পাঠ্যক্রম অনুসরণ, শিক্ষকের সহায়তা নেওয়া ইত্যাদি প্রচেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। এর পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য ও বরকতের জন্য দোয়া করতে হবে। দোয়া প্রচেষ্টাকে ফলপ্রসূ করে, কিন্তু প্রচেষ্টার বিকল্প নয়।
খ. নির্দিষ্ট দোয়া ছাড়া জ্ঞান বাড়বে না?
ভুল ধারণা: কেউ কেউ ভাবেন যে, কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত নির্দিষ্ট কিছু দোয়া (যেমন: “রাব্বি যিদনী ইলমা“) পাঠ না করলে বুঝি জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে না বা অন্য কোনো ভাষায় নিজের মতো করে দোয়া করলে তা কবুল হবে না।
সংশোধন: কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো (মাসনূন দোয়া) নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম, কারণ এগুলো স্বয়ং আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সাঃ) শিক্ষা দিয়েছেন এবং এগুলোর শব্দচয়ন ও ভাব অত্যন্ত গভীর ও বরকতময়। এগুলো পাঠ করলে সওয়াবও বেশি এবং কবুল হওয়ার সম্ভাবনাও অধিক।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, অন্য কোনো দোয়া কবুল হবে না। আল্লাহ তা’আলা বান্দার মনের আকুতি বোঝেন, সে যে ভাষাতেই দোয়া করুক না কেন। যদি কেউ মাসনূন দোয়া না জেনে আন্তরিকতার সাথে নিজের ভাষায় আল্লাহর কাছে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য সাহায্য চায়, তবে আল্লাহ তার দোয়াও কবুল করতে পারেন। মূল বিষয় হলো ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ও অন্তরের আকুতি। তবে, মাসনূন দোয়াগুলো শিখে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত, কারণ তাতে অধিক কল্যাণ নিহিত।
গ. অলৌকিকভাবে জ্ঞান লাভের আশা
ভুল ধারণা: কিছু মানুষ আশা করে যে, বিশেষ কোনো আমল বা দোয়া করার ফলে কোনো প্রকার পড়ালেখা বা প্রচেষ্টা ছাড়াই অলৌকিকভাবে তাদের মধ্যে বিশাল জ্ঞান চলে আসবে।
সংশোধন: আল্লাহ তা’আলা চাইলে যে কাউকে অলৌকিকভাবে জ্ঞান দান করতে পারেন (যাকে ‘ইলমে লাদুন্নী’ বা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান বলা হয়, যেমনটি খিজির (আঃ)-এর ক্ষেত্রে হয়েছিল)। কিন্তু এটি আল্লাহর একটি বিশেষ নিয়ম, যা সকলের জন্য প্রযোজ্য সাধারণ নিয়ম (সুন্নাতুল্লাহ) নয়। জ্ঞানার্জনের সাধারণ নিয়ম হলো চেষ্টা, অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করা। নবী-রাসূলগণও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী লাভ করেছেন, যা এক ধরনের অলৌকিক জ্ঞান, কিন্তু তাঁরাও দ্বীনের অন্যান্য বিষয় শিখতেন এবং সাহাবীদের শেখাতেন।
সাধারণ মানুষের জন্য অলৌকিকভাবে বিশাল জ্ঞান লাভের আশা করে বসে থাকা এবং প্রচেষ্টা ত্যাগ করা ইসলাম সমর্থিত নয়। বরং কঠোর পরিশ্রম ও দোয়ার মাধ্যমেই জ্ঞানার্জনের পথে অগ্রসর হতে হবে।
ঘ. জাগতিক জ্ঞানার্জনের জন্য দোয়া করা উচিত নয়?
ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, দোয়া শুধু পারলৌকিক কল্যাণ বা দ্বীনী জ্ঞানার্জনের জন্যই করা উচিত; পার্থিব বা জাগতিক জ্ঞান (যেমন: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি) লাভের জন্য দোয়া করাটা গুরুত্বহীন বা অনুচিত।
সংশোধন: ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে সুন্দর সমন্বয় সাধন করেছে। যে কোনো উপকারী জ্ঞান (‘ইলমে নাফি’), যা মানবতার কল্যাণে আসে, নিজের ও পরিবারের জন্য হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করে এবং আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে معرفة (গভীর উপলব্ধি) দান করে, তা অর্জন করা ইসলামে প্রশংসনীয়। যদি নিয়ত সঠিক থাকে (যেমন: আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের সেবা, মুসলিম উম্মাহর উন্নতি), তবে জাগতিক জ্ঞানার্জনের জন্যও দোয়া করা সম্পূর্ণ জায়েজ এবং কাম্য।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) “ইলমান নাফি’আ” বা উপকারী জ্ঞানের জন্য দোয়া করতেন, যা দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় প্রকার উপকারী জ্ঞানকেই অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা অন্য কোনো পেশার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করা ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, সেই জ্ঞান যেন আল্লাহর অবাধ্যতা বা মানবতার ক্ষতিতে ব্যবহৃত না হয়।
ইসলামিক ইতিহাসে জ্ঞান সাধকদের দোয়ার ব্যবহার: অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত
ইসলামের সোনালী ইতিহাস জ্ঞানপিপাসু অসংখ্য মনীষীর পদচারণায় মুখর, যাঁরা একদিকে যেমন জ্ঞান সাধনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তেমনই অন্যদিকে আল্লাহর সাহায্যের জন্য দোয়ার প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। তাঁদের জীবন থেকে আমরা অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি।
ক. নবী-রাসূলগণের জ্ঞান চাওয়ার দোয়া
নবী-রাসূলগণ ছিলেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এবং তাঁরাই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ নমুনা পেশ করেছেন। তাঁরাও আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে জ্ঞানের জন্য দোয়া করতেন:
- প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “ওয়া ক্বুল রাব্বি যিদনী ‘ইলমা” (এবং বলুন, ‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’)। (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াত: ১১৪)। এটি প্রমাণ করে যে, জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও আরো জ্ঞান বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা ও দোয়া করা নবীজি (সাঃ)-এর সুন্নত।
- হযরত মূসা (আলাইহিস সালাম): যখন তিনি ফেরাউনের মতো প্রতাপশালী ও উদ্ধত শাসকের কাছে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পেলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, “রাব্বিশরাহ লী সাদ্রী, ওয়া ইয়াসসির লী আমরী, ওয়াহলুল ‘উক্বদাতাম মিল লিসানী, ইয়াফক্বাহু ক্বওলী” (হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন, আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে)। (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াত: ২৫-২৮)। এখানে কথা বলার দক্ষতা ও মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতাও এক ধরনের জ্ঞান, যা তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।
- হযরত সুলাইমান (আলাইহিস সালাম): তিনি আল্লাহর কাছে বিচার ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা প্রার্থনা করেছিলেন, “রাব্বি হাবলী হুকমাও ওয়া আলহিক্বনী বিস সালিহীন” (হে আমার রব, আমাকে প্রজ্ঞা দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন)। (সূরা শু’আরা, আয়াত: ৮৩)।
খ. সাহাবী ও তাবেঈনদের জ্ঞান সাধনা ও দোয়া
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রত্যক্ষ সাহচর্যে থাকা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম তাবেঈনগণ ছিলেন জ্ঞান সাধনার উজ্জ্বল নক্ষত্র।
- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ): তিনি ছিলেন “তরজুমানুল কুরআন” (কুরআনের ব্যাখ্যাকার) এবং “হাবরুল উম্মাহ” (উম্মাহর মহাজ্ঞানী)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছিলেন, “আল্লাহুম্মা ফাক্কিহহু ফিদ্দীন ওয়া ‘আল্লিমহুত তা’বীল” (হে আল্লাহ! তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করুন এবং তাকে কুরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিন)। (মুসনাদে আহমাদ, সহীহ)। এই দোয়ার বরকতে তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন।
- হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ): তিনি অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবীদের অন্যতম। একবার তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে ভুলে যাওয়ার অভিযোগ করলে, রাসূল (সাঃ) তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং কিছু আমল শিখিয়ে দেন, যার ফলে তাঁর স্মরণশক্তি প্রখর হয়। (ঘটনাটি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ আছে)।
- তাবেঈনদের সাধনা: ইমাম হাসান বসরী (রহঃ), ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহঃ) প্রমুখ তাবেঈনগণ জ্ঞানার্জনের জন্য দূর-দূরান্তে সফর করতেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত অধ্যয়ন ও ইবাদতে মগ্ন থাকতেন, পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতেন।
গ. বিখ্যাত ইমাম ও আলেমদের জীবনে দোয়ার প্রভাব
পরবর্তী যুগের ইমাম ও আলেমগণও তাঁদের জ্ঞান সাধনায় দোয়ার গুরুত্বকে উপলব্ধি করেছেন:
- হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ): জগদ্বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ ‘সহীহ আল-বুখারী’ সংকলনের পূর্বে তিনি প্রতিটি হাদিস লেখার আগে গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তেন এবং ইস্তেখারা করতেন (আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা)। তাঁর এই অসাধারণ অধ্যবসায় ও দোয়ার ফলেই এমন একটি বিশুদ্ধ গ্রন্থ উম্মাহ লাভ করেছে।
- ইমাম শাফেয়ী (রহঃ): তাঁর প্রখর মেধা ও স্মরণশক্তির কথা সুবিদিত। তিনি তাঁর উস্তাদ ওয়াকী (রহঃ)-এর কাছে একবার স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার অভিযোগ করলে, উস্তাদ তাঁকে গুনাহ পরিহারের উপদেশ দেন, কারণ জ্ঞান আল্লাহর নূর যা পাপীকে দেওয়া হয় না। এটি পরোক্ষভাবে দোয়ার (গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য) গুরুত্বকেই নির্দেশ করে।
- ইমাম গাজ্জালী (রহঃ): তিনি তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও আলেম ছিলেন। জাগতিক জ্ঞান ও খ্যাতির শীর্ষে থেকেও তিনি একসময় আত্মিক প্রশান্তির জন্য সবকিছু ত্যাগ করে নির্জনে আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন হন এবং সত্য معرفة (প্রকৃত জ্ঞান) লাভের জন্য দোয়া করেন। তাঁর এই আধ্যাত্মিক সফর তাঁকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ (ইসলামের প্রমাণ) উপাধিতে ভূষিত করে।
ঘ. তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা
এই মহান মনীষীদের জীবন থেকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো:
- জ্ঞানার্জনের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম অপরিহার্য।
- প্রচেষ্টার পাশাপাশি সর্বদা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে এবং তাঁর সাহায্য চেয়ে দোয়া করতে হবে।
- ইখলাস বা একনিষ্ঠতা হলো জ্ঞান লাভের অন্যতম শর্ত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জ্ঞানার্জন করতে হবে।
- তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে হবে, কারণ গুনাহ অন্তরের আলো নিভিয়ে দেয় এবং জ্ঞান ধারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
- অর্জিত জ্ঞান মানব কল্যাণে এবং আল্লাহর দ্বীন প্রচারে ব্যয় করার মানসিকতা থাকতে হবে।
তাঁদের জীবনের প্রতিটি পরতে দোয়ার প্রতি এই অবিচল আস্থা ও গুরুত্বারোপ আমাদের জন্য পাথেয়।
শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি ও পড়ালেখায় মনোযোগী করার জন্য দোয়া
শিশুরা হলো কাদামাটির মতো, যাদেরকে সঠিক শিক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হয়। তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি ও পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলার জন্য চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করা পিতামাতা ও অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব।
ক. ছোটদের জন্য সহজ দোয়া
শিশুদের বয়স ও ধারণক্ষমতা বিবেচনা করে তাদেরকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত দোয়া শেখানো উচিত:
- “রাব্বি যিদনী ইলমা” (رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا): “হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” এটি সবচেয়ে সহজ ও অত্যন্ত অর্থবহ দোয়া। শিশুদের এর অর্থ বুঝিয়ে দিলে তারা আগ্রহ নিয়ে পড়বে।
- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” (بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ): যেকোনো পড়া বা ভালো কাজ শুরু করার আগে এটি বলার অভ্যাস করানো। এর অর্থ “পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।” এটি কাজে বরকত আনে।
- “রাব্বি ইয়াসসির ওয়ালা তু’আসসির, ওয়া তাম্মিম বিল খাইর, ওয়া বিকা নাসতা’ঈন” (رَبِّ يَسِّرْ وَلَا تُعَسِّرْ، وَتَمِّمْ بِالْخَيْرِ، وَبِكَ نَسْتَعِيْنُ): “হে আমার রব, সহজ করুন, কঠিন করবেন না। কল্যাণের সাথে পরিসমাপ্তি ঘটান। আর আমরা আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” এই দোয়াটি কোনো কাজ শুরু করার আগে বা কঠিন পড়া শুরু করার আগে শিশুদের শেখানো যেতে পারে।
- সাধারণ ভাষায় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া: “হে আল্লাহ, আমার পড়া সহজ করে দাও”, “আমাকে ভালো ছাত্র/ছাত্রী বানিয়ে দাও” – এভাবে নিজের ভাষায় দোয়া করতেও উৎসাহিত করা।
খ. পিতামাতার করণীয় ও দোয়া
সন্তানের জ্ঞান ও চরিত্র গঠনে পিতামাতার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাদের করণীয় ও দোয়া:
- নিজেদের আমল ঠিক রাখা: পিতামাতা নিজেরা যদি দ্বীনদার ও জ্ঞানপিপাসু হন, তবে সন্তানরাও তা অনুসরণ করতে শেখে।
- সন্তানের জন্য নিয়মিত দোয়া করা: পিতামাতার দোয়া সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে অত্যন্ত দ্রুত কবুল হয়। সন্তানের হেদায়েত, উপকারী জ্ঞান লাভ, ভালো চরিত্র গঠন এবং পড়ালেখায় সাফল্যের জন্য নিয়মিত আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। সূরা ফুরকানের ৭৪ নং আয়াতে আল্লাহ শিখিয়েছেন: “রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্কুররাতা আ’ইউনিও ওয়াজ’আলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমামা” (হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তান দান করুন যারা আমাদের চোখের শীতলতা হবে এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন)।
- শিক্ষা উপকরণ ও পরিবেশ তৈরি: সন্তানের পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ (বই, খাতা, কলম ইত্যাদি) সরবরাহ করা এবং ঘরে একটি শান্ত ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
- আয়াতুল কুরসী ও অন্যান্য দোয়া পাঠ: সন্তানের উপর ফুঁ দেওয়া বা তাদের জন্য আয়াতুল কুরসী, সূরা ফালাক, সূরা নাস ইত্যাদি পড়ে দোয়া করা, যাতে তারা বদনজর ও অন্যান্য অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত থাকে।
গ. পড়াশোনার শুরুতে ও পরীক্ষার আগে পড়ার দোয়া
- পড়াশোনার শুরুতে: “বিসমিল্লাহ” এবং “রাব্বি যিদনী ইলমা” বলার অভ্যাস করানো। সম্ভব হলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে পড়া শুরু করার প্রতি উৎসাহিত করা যেতে পারে (বড়দের জন্য)।
- কঠিন বিষয় অনুভব করলে: “আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জা’আলতাহু সাহলান, ওয়া আনতা তাজ’আলুল হাযনা ইযা শি’তা সাহলান” (হে আল্লাহ, আপনি যা সহজ করেন তা ছাড়া কোনো কিছুই সহজ নয়, আর আপনি যখন ইচ্ছা করেন তখন কঠিন বিষয়ও সহজ করে দেন) – এই দোয়া পাঠ করা যেতে পারে। (সহীহ ইবনে হিব্বান)
- পরীক্ষার আগে: আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াককুল রেখে সাধ্যমতো প্রস্তুতি নেওয়ার পর পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে এবং প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর আল্লাহর সাহায্য চেয়ে দোয়া করা। বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট দোয়া না থাকলেও, “রাব্বি ইয়াসসির…”, “রাব্বি যিদনী ইলমা” অথবা নিজের ভাষায় সাহায্য চাওয়া যায়। পরীক্ষার ভীতি দূর করার জন্য এবং যা পড়া হয়েছে তা স্মরণ করার জন্য দোয়া করা।
ঘ. শিশুদের জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করার ইসলামিক পদ্ধতি
শিশুদের মনে জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
- নবী-রাসূল ও মনীষীদের গল্প শোনানো: নবী-রাসূল, সাহাবী এবং বিখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের জ্ঞান সাধনার শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক গল্প শিশুদের ভাষায় শোনানো।
- প্রশংসা ও পুরস্কার: পড়ালেখায় সামান্য অগ্রগতি হলেও তাদের প্রশংসা করা এবং মাঝে মাঝে ছোটখাটো পুরস্কার দেওয়া।
- কৌতূহল জাগানো: আল্লাহর সৃষ্টি (যেমন: আকাশ, তারা, গাছপালা, প্রাণী) দেখিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন জাগানো এবং সেগুলোর উত্তর অনুসন্ধানে উৎসাহিত করা। এটি তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও জ্ঞানতৃষ্ণা বাড়াবে।
- কুরআন ও হাদিসের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি: ছোটবেলা থেকেই সহজ ভাষায় কুরআনের ছোট ছোট সূরা ও হাদিসের শিক্ষা দেওয়া।
- মক্তব বা ইসলামিক সেন্টারে পাঠানো: যেখানে তারা আনন্দপূর্ণ পরিবেশে দ্বীনী ও প্রাথমিক জাগতিক জ্ঞান লাভ করতে পারে।
- জোর না করা: পড়ালেখার জন্য অতিরিক্ত চাপ বা কঠোর শাসন না করে ভালোবাসা ও উৎসাহের মাধ্যমে তাদের আগ্রহী করে তোলা।
এসব সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি, পড়ালেখায় মনোযোগ এবং আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হবে, ইনশাআল্লাহ।
জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়ার আধ্যাত্মিক ও মানসিক উপকারিতা
জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া শুধু পড়া মনে রাখা বা পরীক্ষায় ভালো করার উপায়ই নয়, বরং এর বহুবিধ আধ্যাত্মিক ও মানসিক উপকারিতা রয়েছে। এগুলো একজন মুমিনের জীবনে গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ক. আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি (তাওয়াক্কুল)
যখন একজন ব্যক্তি তার জ্ঞান, মেধা ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধির জন্য আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, তখন সে মূলত নিজের সীমাবদ্ধতা এবং আল্লাহর অসীম ক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়। এই অনুভূতি তাকে আল্লাহর উপর অধিক নির্ভরশীল (মুতাওয়াক্কিল) করে তোলে। সে বুঝতে পারে যে, প্রকৃত জ্ঞানদাতা হলেন আল্লাহ এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কোনো প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হতে পারে না। এই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা তাকে অহংকার থেকে রক্ষা করে এবং যেকোনো সাফল্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করে।
খ. মানসিক প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস লাভ (সাকীনাহ)
জ্ঞানার্জনের পথ অনেক সময় কঠিন ও শ্রমসাধ্য হতে পারে। পরীক্ষার চাপ, পড়া মনে না থাকার দুশ্চিন্তা ইত্যাদি মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলে অন্তরে এক ধরনের সাকীনাহ বা প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। “আমি আল্লাহর কাছে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি এবং ফলাফলের জন্য তাঁর উপর ভরসা করছি” – এই বিশ্বাস মানসিক চাপ কমায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যখন একজন শিক্ষার্থী জানে যে সে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থী, তখন তার মনোবল দৃঢ় হয় এবং সে অধিক আত্মবিশ্বাসের সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
গ. বিনয় ও নম্রতা অর্জন (খুশূ’)
প্রকৃত জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। দোয়ার মাধ্যমে যখন আল্লাহর কাছে জ্ঞানের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তখন ব্যক্তি তার নিজের অজ্ঞতা ও আল্লাহর জ্ঞানের বিশালতা উপলব্ধি করতে পারে। “সুবহানাকা লা ইলমা লানা ইল্লা মা আল্লামতানা, ইন্নাকা আনতাল আলীমুল হাকীম” (আপনি পরম পবিত্র! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের তো অন্য কোনো জ্ঞানই নেই। নিশ্চয়ই আপনিই সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়) – এই জাতীয় দোয়া ব্যক্তিকে আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র করে তোলে। এই বিনয় তাকে অন্যের কাছ থেকে শিখতে উৎসাহিত করে এবং অর্জিত জ্ঞান নিয়ে গর্ব বা অহংকার করা থেকে বিরত রাখে।
জ্ঞানার্জনের পথে চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো মোকাবেলায় দোয়ার ভূমিকা
জ্ঞানার্জনের পথ সবসময় মসৃণ হয় না। অলসতা, অমনোযোগিতা, কঠিন বিষয় বুঝতে না পারা, হতাশা ইত্যাদি নানা চ্যালেঞ্জ এই পথে আসতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দোয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক. অলসতা ও অমনোযোগিতা দূর করতে দোয়া
অলসতা এবং অমনোযোগ জ্ঞানার্জনের পথে দুটি বড় শত্রু। শয়তান সর্বদা মানুষকে ভালো কাজ থেকে বিরত রাখতে এবং তার মনোযোগ নষ্ট করতে চায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দোয়ার আশ্রয় নেওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ব্যাপক দোয়া করতেন, যার মধ্যে অলসতা থেকেও আশ্রয় চাওয়া হয়েছে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ… (আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান, ওয়াল ‘আজযি ওয়াল কাসাল…) “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি…” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ২৮৯৩) এই দোয়া নিয়মিত পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে দেন এবং অমনোযোগিতা দূর করে দেন।
খ. কঠিন বিষয় বোঝার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা
অনেক সময় কোনো বিষয় শিক্ষার্থীর কাছে অত্যন্ত কঠিন মনে হতে পারে। বার বার চেষ্টা করেও বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে সাহায্য চাওয়া উচিত। মূসা (আঃ) কঠিন দায়িত্ব পালনের পূর্বে দোয়া করেছিলেন:
رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي، وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي، وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي، يَفْقَهُوا قَوْلِي (রাব্বিশ রাহলী সাদ্রী, ওয়া ইয়াসসির লী আমরী, ওয়াহলুল ‘উক্বদাতাম মিল লিসানী, ইয়াফক্বাহু ক্বওলী) “হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন, আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াত: ২৫-২৮) এই দোয়া বা এর মর্মার্থ অনুসারে নিজের ভাষায় দোয়া করলে আল্লাহ তা’আলা কঠিন বিষয় বোঝার ক্ষমতা দান করতে পারেন।
গ. জ্ঞানার্জনে লেগে থাকার (Perseverance) জন্য মানসিক শক্তি অর্জন
জ্ঞানার্জনের জন্য ধৈর্য ও অধ্যবসায় অপরিহার্য। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। এই পথে অবিচল থাকার জন্য মানসিক শক্তি প্রয়োজন, যা দোয়ার মাধ্যমে লাভ করা যায়। আল্লাহর কাছে ইস্তিকামাত (অবিচলতা) এবং সবর (ধৈর্য) প্রার্থনা করা উচিত। যেকোনো ভালো কাজে লেগে থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা এবং শয়তানের প্ররোচনা যেন পথচ্যুত করতে না পারে, সে জন্য দোয়া করা।
ঘ. হতাশা কাটিয়ে উঠতে দোয়ার মাধ্যমে সান্ত্বনা লাভ
বারবার চেষ্টা করার পরও কাঙ্ক্ষিত ফল না পেলে বা পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না হলে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একজন মুমিন হতাশায় ভেঙে পড়ে না, বরং সে আল্লাহর রহমতের দিকে ফিরে যায়। দোয়া হলো হতাশার মুহূর্তে আল্লাহর সাথে কথা বলার এবং তাঁর কাছ থেকে সান্ত্বনা ও দিকনির্দেশনা লাভের মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দার দোয়া শোনেন এবং কখনো তাৎক্ষণিকভাবে, কখনো বিলম্বে, আবার কখনো আখিরাতের জন্য উত্তম কিছু সঞ্চয় রেখে তার প্রতিদান দেন। এই বিশ্বাস হতাশা কাটিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে সাহায্য করে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া ও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন উদয় হতে পারে। নিম্নে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হলো:
ক. জ্ঞান বৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকরী ও সহজ দোয়া কোনটি?
উত্তর: জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে সহজ, সংক্ষিপ্ত এবং কুরআন দ্বারা প্রমাণিত দোয়া হলো: “রাব্বি যিদনী ইলমা” (رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا) – “হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা ত্বোয়া-হা, আয়াত: ১১৪)। এটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক এবং যেকোনো প্রকার উপকারী জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য এই দোয়া পাঠ করা যায়।
খ. এই দোয়াগুলো দিনে কতবার বা কখন পড়া উচিত?
উত্তর: জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়াগুলো পাঠ করার জন্য দিনে কতবার পড়তে হবে এমন কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা হাদিসে নির্ধারিত নেই। তবে, যত বেশি সম্ভব এবং যত আন্তরিকতার সাথে পড়া যায় ততই উত্তম। বিশেষ করে পড়াশোনা শুরু করার আগে, নামাজের পর, তাহাজ্জুদের সময়, বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার আগে এই দোয়াগুলো পাঠ করা যেতে পারে। মূল বিষয় হলো নিয়মিত ও নিষ্ঠার সাথে দোয়া করা।
গ. পড়া মনে রাখার জন্য বিশেষ কোনো দোয়া আছে কি?
উত্তর: উপরে আলোচিত দোয়াগুলো (যেমন: “রাব্বি যিদনী ইলমা”, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি’আ…”) পড়া মনে রাখার জন্যও অত্যন্ত উপকারী, কারণ জ্ঞান বৃদ্ধি এবং তা ধারণ (মনে রাখা) অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর পাশাপাশি, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এবং মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
ঘ. দোয়া করার পরও পরীক্ষায় ভালো ফল না আসলে কী করণীয়?
উত্তর: প্রথমত, নিজের প্রচেষ্টার দিকে ফিরে তাকাতে হবে যে তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং বিশ্বাস রাখতে হবে যে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো কল্যাণ নিহিত আছে যা আমরা বুঝতে পারছি না। আল্লাহ তা’আলা কখনো বান্দার দোয়া তাৎক্ষণিকভাবে কবুল করেন, কখনো বিলম্বে কবুল করেন, আবার কখনো তার পরিবর্তে দুনিয়া বা আখিরাতে এর চেয়েও উত্তম কিছু দান করেন অথবা কোনো বিপদ দূর করে দেন। হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে, প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে এবং আল্লাহর কাছে দোয়াও চালিয়ে যেতে হবে।
ঙ. জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়ার পাশাপাশি আর কী কী করা যেতে পারে?
উত্তর: জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়ার পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত:
- নিয়মিত ও মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করা।
- শিক্ষকদের সম্মান করা এবং তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করা।
- অর্জিত জ্ঞান আলোচনা ও পুনরালোচনা করা।
- গুনাহ থেকে, বিশেষ করে চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা (পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্য)।
- সময়ের সদ্ব্যবহার করা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।
- কুরআন ও হাদিস নিয়মিত পাঠ করা।
- বিনয়ী থাকা এবং শেখার মানসিকতা বজায় রাখা।
এই সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জ্ঞানার্জনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করা সম্ভব, ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়ুন: রোগ মুক্তির দোয়া : কুরআন ও হাদিসের আলোকে আরোগ্য লাভের শক্তিশালী আমল
উপসংহার: জ্ঞানার্জন এক চলমান সফর – দোয়া ও প্রচেষ্টার সমন্বয়
ইসলামে জ্ঞানার্জনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এক চলমান সফর। এই পবিত্র সফরে সাফল্য লাভের জন্য প্রয়োজন আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি একান্ত নির্ভরশীলতা ও প্রার্থনা। এই আর্টিকেলে আমরা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া, তার গুরুত্ব, নিয়মাবলী, সহায়ক আমল এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।পরিশেষে, আমরা আল্লাহর দরবারে এই দোয়া করি: اللَّهُمَّ انْفَعْنَا بِمَا عَلَّمْتَنَا، وَعَلِّمْنَا مَا يَنْفَعُنَا، وَزِدْنَا عِلْمًا، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ(আল্লাহুম্মানফা’না বিমা ‘আল্লামতানা, ওয়া ‘আল্লিমনা মা ইয়ানফা’উনা, ওয়া যিদনা ‘ইলমা, ওয়ালহামদু লিল্লাহি ‘আলা কুল্লি হা-ল) “হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তার দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন। আর যা আমাদের উপকারে আসবে, তা আমাদেরকে শিক্ষা দিন এবং আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন। সর্বাবস্থায় সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।” আমীন।
জ্ঞান বৃদ্ধির দোয়া : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!