বছর ঘুরে মুসলিম উম্মাহর দ্বারে আবারও সমাগত ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। এই উৎসবের প্রধানতম আমল হলো কোরবানি, যা শুধুমাত্র একটি পশু উৎসর্গ করার আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং মহান আল্লাহর প্রতি বান্দার নিরঙ্কুশ আনুগত্য, গভীর ভালোবাসা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের এক জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহর খলিল হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)-এর অতুলনীয় আত্মত্যাগের পুণ্যস্মৃতিবিজড়িত এই মহান ইবাদতটি যথাযথভাবে পালনের জন্য এর নিয়ম-কানুন, বিশেষত কোরবানির দোয়া সম্পর্কে প্রতিটি মুসলমানের স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। বর্তমান নিবন্ধে আমরা কোরবানির দোয়া কখন এবং কীভাবে পাঠ করতে হয়, এর বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ, কোরবানির পশু নির্বাচন ও জবাইয়ের শরয়ী পদ্ধতি, কোরবানির গোশত বণ্টনের নীতিমালা এবং এই ইবাদতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত ও প্রামাণিক আলোচনা উপস্থাপনের প্রয়াস পাবো, ইনশাআল্লাহ। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, সম্মানিত পাঠকবর্গ যেন এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি এর প্রকৃত روح (স্পিরিট) উপলব্ধি করে, বিশুদ্ধভাবে সম্পাদন করতে পারেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হন।
কোরবানি কী? পরিচিতি, ধর্মীয় গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কোরবানি ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। এর সঠিক পরিচিতি, ধর্মীয় ভিত্তি এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি।
ক. ‘কোরবানি’ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরব’ (قُرْب) ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার আভিধানিক অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য, উৎসর্গ বা ত্যাগ। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, ‘কোরবানি’ বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট দিনে (যিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে) আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা বা জবাই করা। এটিকে ‘উযহিয়্যাহ’ (أُضْحِيَّة) বা ‘নাহর’ (نَحْر – বিশেষত উট কোরবানির ক্ষেত্রে)ও বলা হয়।
খ. কোরবানির ধর্মীয় ভিত্তি: পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে
কোরবানি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
- i. সূরা আল-কাউসার, সূরা আস-সাফফাত, সূরা আল-হাজ্জ থেকে উদ্ধৃতি: মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন: “فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ” অর্থ: “অতএব, আপনার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।” (সূরা আল-কাউসার, আয়াত: ২)
হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এর কোরবানির ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ” অর্থ: “এবং আমি এক মহান কোরবানির (একটি জান্নাতী দুম্বা) বিনিময়ে তাকে (ইসমাইলকে) মুক্ত করলাম।” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০৭)
সূরা আল-হাজ্জে আল্লাহ তা’আলা কোরবানির পশুকে ‘শা’আইরুল্লাহ’ বা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন: “وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ ۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ…” অর্থ: “আর কোরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম করেছি; তোমাদের জন্য এতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় এগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো…” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৬) - ii. কোরবানির অপরিহার্যতা ও ফজিলত সংক্রান্ত হাদিস: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে কোরবানি করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিস শরীফে এর বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর নিকট নেই। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট তা বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ১৪৯৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৬)
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বর্ণনা করেন, সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই কোরবানি কী?’ তিনি বললেন, ‘এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত।’ তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘(কোরবানির পশুর) প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে।’ (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৭; মুসনাদে আহমাদ)
গ. কোরবানির মূল উদ্দেশ্য: তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ
কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা। পশুর রক্ত বা মাংস আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে বান্দার তাকওয়া। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ” অর্থ: “আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৭) সুতরাং, লোকদেখানো বা সামাজিক প্রথার বশবর্তী হয়ে নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একনিষ্ঠ নিয়তে কোরবানি করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
ঘ. কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর অবিস্মরণীয় ত্যাগ
কোরবানির বর্তমান প্রেক্ষাপট মূলত আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)-এর অতুলনীয় আত্মত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত।
- i. আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার বিবরণ ও স্বপ্নের ঘটনা: হযরত ইবরাহীম (আঃ) বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর কাছে একটি নেক সন্তানের জন্য দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে ধৈর্যশীল পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে দান করেন। যখন ইসমাইল (আঃ) পিতার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম (আঃ)-কে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার জন্য, যা ছিল তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ)। নবীদের স্বপ্নও ওহীর অন্তর্ভুক্ত।
- ii. পিতা-পুত্রের আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ ও আত্মত্যাগের প্রস্তুতি: হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বপ্নের কথা তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে জানালেন। বালক ইসমাইল (আঃ) আল্লাহর হুকুম পালনে পিতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে বললেন, “হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০২)। এই কথোপকথন পিতা-পুত্রের আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য ও আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত।
- iii. হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হওয়ার ঐশী ঘটনা: যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হলেন এবং শয়তানের সকল প্ররোচনা উপেক্ষা করে আল্লাহর নির্দেশ পালনে অবিচল থাকলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর এই ত্যাগ ও আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন, যা ইসমাইল (আঃ)-এর বদলে কোরবানি করা হয়। (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০৩-১০৭)
- iv. এই ঘটনা থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য চিরন্তন শিক্ষণীয় বিষয়: এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো: ১. আল্লাহর নির্দেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। ২. তাকওয়া ও ইখলাস (একনিষ্ঠতা)। ৩. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুও ত্যাগ করার মানসিকতা। ৪. ধৈর্য ও আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা। এই শিক্ষাই কোরবানির মূল চেতনা, যা প্রতি বছর মুসলমানদের জীবনে নতুন করে প্রেরণা জোগায়।
কাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব? শর্তাবলী ও নিসাব পরিমাণ
ইসলামী শরীয়তে সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কোরবানি করা ওয়াজিব (আবশ্যক)। তবে এই ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে, যা পূরণসাপেক্ষে একজন মুসলমানের উপর কোরবানি আবশ্যক হয়।
ক. কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য ইসলামি শরীয়তের বিধান
হানাফী মাযহাব অনুসারে, প্রত্যেক সুস্থমস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, মুকীম (স্থায়ী বাসিন্দা) মুসলমান নর-নারী, যিনি কোরবানির দিনগুলোতে (যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত) প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন, তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। অন্যান্য কিছু মাযহাবে এটিকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ) বলা হয়েছে, তবে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতে এটি ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৩; মুসনাদে আহমাদ। এই হাদিসের সনদ বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের ভিন্নমত থাকলেও এটি কোরবানির গুরুত্ব নির্দেশ করে)।
খ. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানা: বিস্তারিত ব্যাখ্যা (সোনা, রুপা বা সমমূল্যের সম্পদ)
নেসাব হলো শরীয়ত নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ, যার মালিক হলে যাকাত ও কোরবানি ওয়াজিব হয়। কোরবানির নেসাব হলো:
- সাড়ে সাত (৭.৫) তোলা/ভরি স্বর্ণ (প্রায় ৮৭.৪৫ গ্রাম)।
- অথবা, সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) তোলা/ভরি রুপা (প্রায় ৬১২.১৫ গ্রাম)।
- অথবা, এই পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপার যেকোনো একটির বর্তমান বাজারমূল্যের সমপরিমাণ নগদ টাকা, ব্যবসায়িক পণ্য অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্যান্য সামগ্রী।
এখানে লক্ষণীয় যে, যাকাতের নেসাবের ক্ষেত্রে সম্পদ পূর্ণ এক বছর অধিকারে থাকা শর্ত, কিন্তু কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে কোরবানির দিনগুলোতে (যিলহজ্জের ১০, ১১ বা ১২ তারিখে) এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই যথেষ্ট; সম্পদ পূর্ণ এক বছর অধিকারে থাকা শর্ত নয়। এছাড়াও, কোরবানির নেসাব হিসাব করার সময় নিজের ও পরিবারের আবশ্যকীয় প্রয়োজন (যেমন: বাসস্থান, পরিধেয় বস্ত্র, খাবার, অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র, বাহন ইত্যাদি) বাদ দিয়ে অতিরিক্ত সম্পদের হিসাব করতে হবে।
গ. মুকীম (স্থায়ী বাসিন্দা) ও বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়ার শর্ত
- মুকীম: মুসাফির বা ভ্রমণরত ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। মুকীম অর্থাৎ, যিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন বা কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেছেন, তার উপর নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে কোরবানি ওয়াজিব।
- বালিগ: নাবালেগ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, এমনকি যদি তারা নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকও হয়। তবে অভিভাবক তাদের পক্ষ থেকে নফল হিসেবে কোরবানি করতে পারেন।
ঘ. পরিবারের পক্ষ থেকে একজনের কোরবানি এবং সকলের পক্ষ থেকে আদায় হওয়ার মাসআলা
একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি নেসাবের মালিক হন, তবে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। যদি পরিবারের একাধিক সদস্য (যেমন: স্বামী-স্ত্রী উভয়েই) পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হন, তবে প্রত্যেকের উপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব হবে। একটি কোরবানি (যেমন একটি ছাগল) একজনের পক্ষ থেকেই আদায় হবে। তবে গরুতে সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারে, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যেন নেসাবের মালিক হন অথবা কমপক্ষে নফল কোরবানির নিয়ত করেন।
ঙ. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কোরবানির বিধান
যদি কোনো ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত হন যে, ঋণ পরিশোধ করলে তার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না, তবে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তবে, যদি ঋণ পরিশোধের পরও নেসাব পরিমাণ সম্পদ টিকে থাকে, অথবা এমন ঋণ হয় যা পরিশোধের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে আছে এবং কোরবানির কারণে ঋণ পরিশোধে অসুবিধা হবে না, সেক্ষেত্রে কোরবানি ওয়াজিব হবে। অগ্রাধিকার হলো ঋণ পরিশোধ করা।
কোরবানির পশু নির্বাচন: বয়স, শারীরিক ত্রুটি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
কোরবানির জন্য পশু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পশু, তাদের বয়স এবং শারীরিক ত্রুটিমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
ক. কোরবানির জন্য শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পশুসমূহ (উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা)
যেসব পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ, সেগুলো হলো: ১. উট ২. গরু ৩. মহিষ ৪. ছাগল (খাসি, পাঁঠা, বকরী) ৫. ভেড়া ৬. দুম্বা এগুলো ছাড়া অন্য কোনো পশু, যেমন হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়।
খ. প্রতিটি পশুর জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা
কোরবানির পশুর একটি নির্দিষ্ট বয়স পূর্ণ হওয়া আবশ্যক। বয়স পূর্ণ না হলে সেই পশু দ্বারা কোরবানি সহীহ হবে না।
- উট: কমপক্ষে ৫ বছর পূর্ণ হতে হবে।
- গরু ও মহিষ: কমপক্ষে ২ বছর পূর্ণ হতে হবে।
- ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা: কমপক্ষে ১ বছর পূর্ণ হতে হবে। তবে, ভেড়া বা দুম্বা যদি ১ বছরের কম বয়সীও হয়, কিন্তু দেখতে ১ বছরের মতো হৃষ্টপুষ্ট হয় (অর্থাৎ, ১ বছর বয়সী ভেড়া/দুম্বার পালের সাথে ছেড়ে দিলে সেটিকে আলাদা করে চেনা না যায়), তাহলে তা দ্বারা কোরবানি জায়েজ। কিন্তু ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর পূর্ণ হওয়াই শর্ত।
গ. পশুর শারীরিক ত্রুটিমুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা: যে সকল ত্রুটির কারণে কোরবানি জায়েজ হয় না
কোরবানির পশু যাবতীয় শারীরিক ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া উত্তম। তবে কিছু ত্রুটি এমন রয়েছে, যা থাকলে কোরবানি সহীহ হয় না। যেমন: ১. অন্ধত্ব: যে পশু এক বা উভয় চোখে দেখে না। ২. খোঁড়া: যে পশু এমন খোঁড়া যে, জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না। ৩. চরম দুর্বলতা ও শীর্ণতা: যে পশু এতই দুর্বল বা রুগ্ন যে, তার হাড়ে মগজ শুকিয়ে গেছে। ৪. গুরুতর রোগ: যে পশু এমন কোনো রোগে আক্রান্ত যা তার গোশতকে নষ্ট করে দেয়। ৫. কান বা লেজের অধিকাংশ কাটা: যদি কোনো পশুর কান বা লেজের এক-তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকে। ৬. শিং মূল থেকে ভেঙে যাওয়া: যদি শিং এমনভাবে ভেঙে যায় যে, মস্তিষ্কে আঘাত লাগে বা ক্ষতি হয়। (শুধুমাত্র শিং না থাকা বা অল্প ভাঙা দোষণীয় নয়)। ৭. জন্মগতভাবে কান না থাকা। ৮. দাঁত অধিকাংশ পড়ে যাওয়া: যে পশুর এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, সে ঠিকমতো ঘাস বা খাবার খেতে পারে না।
এছাড়াও ছোটখাটো ত্রুটি, যেমন সামান্য কান ছেঁড়া বা সামান্য শিং ভাঙা, যদি তা এক-তৃতীয়াংশের কম হয়, তবে কোরবানি জায়েজ হবে, যদিও ত্রুটিমুক্ত পশু কোরবানি করাই সর্বোত্তম।
ঘ. উত্তম পশু ক্রয়ের গুরুত্ব ও ফজিলত
কোরবানির জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোত্তম, সুস্থ, সবল ও দেখতে সুন্দর পশু নির্বাচন করা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সুন্দর ও উত্তম পশু কোরবানি করতেন। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটে এবং সওয়াবও বেশি পাওয়ার আশা করা যায়।
ঙ. শরিকানায় কোরবানি: নিয়মাবলী ও অংশীদারের সংখ্যা (গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ ৭ জন)
ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা শুধুমাত্র একজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়। তবে উট, গরু ও মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কোরবানি করতে পারেন।
- i. শরিকদের সকলের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব: শরিকানায় কোরবানির ক্ষেত্রে প্রত্যেক শরিকের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। যদি কোনো একজন শরিকের নিয়ত শুধুমাত্র গোশত খাওয়া হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন না হয়, তাহলে সকলের কোরবানিই বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই, প্রত্যেক শরিকের নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করা হতে হবে।
- ii. আকিকা বা অন্য কোনো নিয়তে শরিক হওয়ার বিধান: কোরবানির সাথে আকিকার নিয়তে শরিক হওয়া জায়েজ আছে (ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর মতে)। অর্থাৎ, একই গরুতে কেউ কোরবানির নিয়তে, কেউ আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। তবে সকলের উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হতে হবে।
কোরবানির দোয়া: কখন, কোনটি এবং কীভাবে পড়বেন? (বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ)
কোরবানির পশু জবাই করার সময় নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করা সুন্নাহ। এই দোয়াগুলো জানা ও সঠিকভাবে পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক. কোরবানির পশু ক্বিবলামুখী করার নিয়ম ও তাৎপর্য
কোরবানির পশুকে জবাই করার সময় ক্বিবলার দিকে মুখ করে শোয়ানো সুন্নাত। যদি ক্বিবলামুখী করতে অসুবিধা হয় বা ভুলবশত অন্য দিকে মুখ করেও জবাই করা হয়, তাহলেও কোরবানি শুদ্ধ হয়ে যাবে, তবে সুন্নাতের খেলাফ হবে। এর তাৎপর্য হলো, জীবনের প্রতিটি কাজের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটিও আল্লাহর নির্দেশিত ক্বিবলার দিকে মুখ করে সম্পন্ন করা, যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের প্রকাশ।
খ. পশু জবাই করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পঠিতব্য দোয়া:
- i. আল্লাহর নাম নেওয়া: “بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ” (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলার আবশ্যকতা ও ফজিলত। জবাই করার ঠিক আগে, ছুরি চালানোর মুহূর্তে সুস্পষ্টভাবে “بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ” (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলা ওয়াজিব (আবশ্যক)। এর অর্থ: “আল্লাহর নামে (শুরু করছি) এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।” ইচ্ছাকৃতভাবে এটি ছেড়ে দিলে জবাইকৃত পশু হারাম হয়ে যাবে (আল্লাহ রক্ষা করুন)। এর ফজিলত হলো, আল্লাহর নামে উৎসর্গীকৃত বস্তুতে বরকত হয় এবং তা আল্লাহর নিকট গৃহীত হয়।
- ii. মূল দোয়া (ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতে পঠিতব্য): “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলার আগে এই দোয়াটি পাঠ করা মুস্তাহাব।
- আরবি: إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا ۖ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ. إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ (বা مِنَ الْمُسْلِمِينَ). اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ.
- বাংলা উচ্চারণ: “ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজ্হিয়া লিল্লাযী ফাত্বোরাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল্ আরদ্বোয়া হানীফাওঁ ওয়া মা আনা মিনাল্ মুশরিকীন। ইন্না সালা-তী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রব্বিল্ ‘আ-লামীন। লা শারীকা লাহূ ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু ওয়া আনা আওয়ালুল্ মুসলিমীন (অথবা, ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন)। আল্লা-হুম্মা মিনকা ওয়ালাকা।”
- বাংলা অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে আমার মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি অংশীবাদীদের (মুশরিকদের) অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি (ও অন্যান্য সকল ইবাদত), আমার জীবন ও আমার মরণ সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোনো অংশীদার নেই, আর আমি এরই প্রতি (এই ঘোষণার প্রতি) আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে প্রথম (অথবা, আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত)। হে আল্লাহ! (এই কোরবানির পশু) তোমার পক্ষ থেকে (তোমারই দান) এবং তোমারই জন্য (তোমাকেই উৎসর্গিত)।” (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৮৬; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২১)
গ. নিজের কোরবানি হলে এর পরে যা যোগ করবেন (জবাই করার সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলার পর):
যদি ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করেন, তবে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলার পর এবং পশুতে ছুরি চালানোর সময় মনে মনে বা মৃদুস্বরে বলতে পারেন:
- আরবি: اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي
- বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্নী।”
- বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন।” অথবা, “اللَّهُمَّ هَذَا مِنْكَ وَلَكَ، اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي” (আল্লা-হুম্মা হাযা মিনকা ওয়ালাকা, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নী) অর্থ: “হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমারই জন্য। হে আল্লাহ! আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন।”
ঘ. অন্যের (যেমন: মৃত পিতা-মাতা বা অনুপস্থিত সন্তানের) নামে কোরবানি করলে তার নাম উল্লেখ করার নিয়ম ও দোয়া:
যদি অন্যের পক্ষ থেকে (যেমন: নফল হিসেবে মৃত পিতা-মাতা বা সন্তানের পক্ষ থেকে) কোরবানি করা হয়, তবে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলার পর এবং পশুতে ছুরি চালানোর সময় তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করতে হবে। যেমন:
- আরবি: اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ فُلاَنٍ (এখানে ‘ফুলান’ এর স্থলে যার নামে কোরবানি তার নাম উল্লেখ করতে হবে। যেমন, পিতার নাম আব্দুল্লাহ হলে: اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ عَبْدِ اللهِ)
- বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা তাক্বাব্বাল মিন (অমুক)।”
- বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! (অমুকের) পক্ষ থেকে কবুল করুন।”
ঙ. জবাই সম্পন্ন করার পর পঠিতব্য দোয়া:
পশু জবাই সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হওয়ার পর এই দোয়াটি পাঠ করা যেতে পারে:
- আরবি: اللَّهُمَّ تَقَبَّلْهُ مِنِّي (বা مِنْ فُلاَنٍ) كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيبِكَ مُحَمَّدٍ وَخَلِيلِكَ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِمَا الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ.
- বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা তাক্বাব্বালহু মিন্নী (অথবা, মিন ফুলানিন্) কামা তাক্বাব্বালতা মিন্ হাবীবিকা মুহাম্মাদিন ওয়া খালীলিকা ইবরা-হীমা ‘আলাইহিমাস্ সালা-তু ওয়াস্ সালাম।”
- বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! এই কোরবানি আমার (অথবা অমুকের) পক্ষ থেকে কবুল করুন, যেমনভাবে আপনি কবুল করেছিলেন আপনার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (ﷺ) এবং আপনার খলীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর পক্ষ থেকে।”
চ. যারা আরবি দোয়া জানেন না বা মুখস্থ নেই তাদের করণীয় কী?
- i. শুধুমাত্র “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে জবাই করার বিধান। যদি উপরে উল্লেখিত দীর্ঘ দোয়াগুলো মুখস্থ না থাকে বা পাঠ করতে অসুবিধা হয়, তবে কোরবানির পশু জবাই করার সময় শুধুমাত্র “بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ” (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) সুস্পষ্টভাবে পাঠ করে জবাই করলেই কোরবানি শুদ্ধ হয়ে যাবে এবং ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
- ii. নিয়তের গুরুত্ব এবং নিজের ভাষায় আল্লাহর কাছে কবুলিয়াতের জন্য প্রার্থনা। কোরবানির মূল বিষয় হলো বিশুদ্ধ নিয়ত বা আন্তরিক সংকল্প। যদি আরবি দোয়া জানা না থাকে, তবে মনে মনে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করার নিয়ত করা এবং জবাইয়ের পর নিজের ভাষায় আল্লাহর কাছে এই কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করা যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা অন্তরের অবস্থাই দেখেন।
কোরবানির পশু জবাই করার সঠিক পদ্ধতি, আদব ও সতর্কতা
কোরবানির পশু সঠিকভাবে জবাই করা এবং এর সংশ্লিষ্ট আদব ও সতর্কতা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। এতে পশুর কষ্ট কম হয় এবং ইবাদতটিও সুন্নাহসম্মতভাবে পালিত হয়।
ক. জবাইকারী ব্যক্তির যোগ্যতা:
মুসলমান হওয়া, জ্ঞান থাকা, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া। জবাইকারী ব্যক্তির নিম্নলিখিত যোগ্যতা থাকা আবশ্যক: ১. মুসলমান হওয়া: অমুসলিম ব্যক্তির জবাইকৃত পশুর গোশত খাওয়া জায়েজ নয়। ২. জ্ঞান থাকা: জবাইয়ের সঠিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবগত থাকা। ৩. সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হওয়া: পাগল বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির জবাই শুদ্ধ নয়। ৪. পুরুষ বা মহিলা উভয়েই জবাই করতে পারেন, যদি তাদের যোগ্যতা থাকে। আহলে কিতাব (ইহুদী বা খ্রিস্টান) যদি আল্লাহর নামে তাদের ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী জবাই করে, তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা হালাল হতে পারে, তবে মুসলমানের হাতে জবাই হওয়াই সর্বোত্তম ও নিরাপদ।
খ. ধারালো অস্ত্র ব্যবহারের গুরুত্ব এবং পশুকে যথাসম্ভব কম কষ্ট দেওয়ার নির্দেশ:
জবাই করার জন্য অত্যন্ত ধারালো ছুরি বা অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে, যাতে এক আঘাতেই বা কম সময়ে জবাই সম্পন্ন হয় এবং পশুর অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না হয়। ভোঁতা অস্ত্র দ্বারা পশুকে কষ্ট দেওয়া মাকরূহ ও অনুচিত।
- i. পশুর সামনে ছুরি ধার না দেওয়া, এক পশুর সামনে অন্য পশু জবাই না করা। এটি পশুর প্রতি দয়ার্দ্রতা ও ইসলামী শিষ্টাচারের অংশ যে, যে পশুকে জবাই করা হবে, তার সামনে ছুরি ধার দেওয়া উচিত নয়। একইভাবে, একটি পশুর সামনে অন্য পশুকে জবাই করা থেকেও বিরত থাকা উচিত, কারণ এতে পশুরা ভীত ও আতঙ্কিত হতে পারে।
গ. জবাইয়ের সময় যা যা অবশ্যই কাটতে হবে:
শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং উভয় পাশের শাহরগ (দুটি রক্তনালী)। জবাই করার সময় পশুর গলার চারটি প্রধান রগ কাটতে হয়: ১. শ্বাসনালী (الحلقوم – হুলকুম): যার মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল করে। ২. খাদ্যনালী (المرئ – মারী’): যার মাধ্যমে খাদ্য ও পানীয় পেটে প্রবেশ করে। ৩. দু’টি শাহরগ (الودجان – ওয়াদাজান): গলার দুই পাশে অবস্থিত দু’টি মোটা রক্তনালী, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে। এই চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ (শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং যেকোনো একটি শাহরগ) কাটা হলেই জবাই শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। তবে উত্তম হলো চারটি রগই কেটে দেওয়া, যাতে পশুর প্রাণ দ্রুত ও সহজে বের হয়ে যায়।
ঘ. পশুর প্রাণ পুরোপুরি বের না হওয়া পর্যন্ত চামড়া ছাড়ানো বা কোনো অঙ্গ কাটা থেকে বিরত থাকা:
জবাই করার পর পশু নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত এবং তার শরীর থেকে রক্ত সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে যাওয়ার আগে চামড়া ছাড়ানো, কোনো অঙ্গ কাটা (যেমন: পা বা মাথা) অথবা ঘাড় মটকানো জায়েজ নয়। এতে পশুকে অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়া হয়। পশুর শরীর ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।
ঙ. জবাইয়ের স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ করা:
কোরবানির স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। জবাইয়ের পর রক্ত, আবর্জনা ও পশুর উচ্ছিষ্টাংশ দ্রুততার সাথে সরিয়ে ফেলা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে বর্জ্য পুঁতে ফেলা বা সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভার নির্ধারিত স্থানে ফেলা উচিত।
চ. নিজে কোরবানি করতে না পারলে যোগ্য প্রতিনিধি নিয়োগ এবং সম্ভব হলে নিজে উপস্থিত থাকা:
নিজের কোরবানি নিজে জবাই করাই উত্তম ও সুন্নাহ। যদি নিজে জবাই করতে অপারগ হন বা সঠিকভাবে জবাই করার জ্ঞান না থাকে, তবে অন্য কোনো যোগ্য মুসলমান ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করা জায়েজ আছে। সেক্ষেত্রে, সম্ভব হলে কোরবানির সময় নিজে উপস্থিত থাকা মুস্তাহাব। এতে কোরবানির প্রতি আন্তরিকতা ও গুরুত্ব প্রকাশ পায়।
কোরবানির গোশত বণ্টন: সুন্নাহসম্মত নিয়ম, পরিমাণ ও সামাজিক তাৎপর্য
কোরবানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর গোশত সঠিকভাবে বণ্টন করা। এর মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নির্দেশ পালিত হয়, তেমনি সামাজিক সম্প্রীতি ও দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়।
ক. গোশত তিন ভাগ করার মুস্তাহাব নিয়ম:
(একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য এবং একভাগ দরিদ্র ও মিসকিনদের জন্য) কোরবানির গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও উত্তম (মুস্তাহাব) পদ্ধতি হলো তা তিন ভাগে ভাগ করা: ১.প্রথম ভাগ: নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য। ২. দ্বিতীয় ভাগ: আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের জন্য (তারা সচ্ছল হলেও)। ৩. তৃতীয় ভাগ: দরিদ্র, মিসকিন ও অভাবীদের জন্য।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ২৮)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: “…তখন তা থেকে তোমরা খাও এবং যারা চায় না তাদেরও খাওয়াও এবং যারা চায় তাদেরও খাওয়াও…” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৬)। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর কোরবানির গোশত তিন ভাগ করতেন: এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য, এক ভাগ দরিদ্র প্রতিবেশীদের জন্য এবং এক ভাগ ভিক্ষুকদের (সাহায্যপ্রার্থী) মধ্যে বণ্টন করতেন। (আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ)।
তবে, এটি একটি মুস্তাহাব নিয়ম, আবশ্যক নয়। কোরবানিদাতা চাইলে পুরো গোশতই নিজে রাখতে পারেন, অথবা পুরোটাই দান করে দিতে পারেন। তবে উল্লেখিত তিন ভাগ করে বণ্টন করাই সর্বোত্তম এবং এর মাধ্যমে কোরবানির সামাজিক উদ্দেশ্য সাধিত হয়। যদি পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হয়, তবে নিজের জন্য বেশিও রাখতে পারেন।
খ. দরিদ্র ও অভাবীদের অধিকার নিশ্চিত করার গুরুত্ব ও ফজিলত
কোরবানির মাধ্যমে দরিদ্র ও অভাবী মানুষেরা বছরের একটা সময়ে উন্নতমানের খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়। তাদের এই অধিকার নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। ধনীদের সম্পদে গরীবদের হক রয়েছে এবং কোরবানির গোশতের মাধ্যমে এই হক আদায়ের একটি সুন্দর ব্যবস্থা ইসলামে রাখা হয়েছে। দরিদ্রদের মাঝে গোশত বিতরণের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটানো আল্লাহর নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় আমল এবং এতে অশেষ সওয়াব নিহিত রয়েছে।
গ. অমুসলিম আত্মীয় বা প্রতিবেশীকে কোরবানির গোশত দেওয়ার বিধান
অমুসলিম প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব যদি দরিদ্র হয় অথবা তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কোরবানির গোশত হাদিয়া হিসেবে দেওয়া জায়েজ আছে। এতে ইসলামের উদারতা ও অসাম্প্রদায়িকতার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। তবে যাকাত, ফিতরা যেমন অমুসলিমকে দেওয়া যায় না, কোরবানির ওয়াজিব অংশ (যদি মান্নত বা কাফফারার কোরবানি হয়) তাদের দেওয়া যাবে না। নফল বা সাধারণ ওয়াজিব কোরবানির গোশত অমুসলিমকে দেওয়াতে কোনো বাধা নেই।
ঘ. কোরবানির গোশত কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে?
এ সংক্রান্ত মাসআলা কোরবানির গোশত প্রয়োজন অনুযায়ী যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করা জায়েজ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে দুর্ভিক্ষ বা অভাবের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করতে নিষেধ করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন অভাব দূর হয়ে যায়, তখন তিনি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং বলেন: “তোমরা খাও, জমা রাখো এবং দান করো।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৭১)। সুতরাং, বর্তমানে কোরবানির গোশত ফ্রিজে বা অন্য কোনো উপায়ে শুকিয়ে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে কোনো বাধা নেই।
ঙ. কোরবানির চামড়া:
বিক্রয়লব্ধ অর্থ সদকা করা বা নিজে ব্যবহার করার বিধান। পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া দেওয়া নিষিদ্ধ। কোরবানির পশুর চামড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই চামড়া কোরবানিদাতা নিজে ব্যবহার করতে পারেন (যেমন: জায়নামাজ, মশ্ক ইত্যাদি তৈরি করে)। যদি নিজে ব্যবহার না করেন, তবে তা কোনো দরিদ্র বা মিসকিনকে দান করে দেওয়া উত্তম। অথবা, চামড়া বিক্রি করে সেই বিক্রয়লব্ধ সম্পূর্ণ অর্থ দরিদ্র ও মিসকিনদের মধ্যে সদকা করে দিতে হবে। কোনো মাদ্রাসা বা এতিমখানায় লিল্লাহ বোর্ডিং থাকলে সেখানেও দেওয়া যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোরবানির পশুর চামড়া বা তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ কসাই বা জবাইকারীকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নেই। তাদের পারিশ্রমিক আলাদাভাবে নগদ অর্থে পরিশোধ করতে হবে। হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে তাঁর কোরবানির উটের তত্ত্বাবধান করতে নির্দেশ দেন এবং এর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনবস্ত্র সদকা করে দিতে বলেন। আর এর কোনো অংশ কসাইকে (পারিশ্রমিক হিসেবে) দিতে নিষেধ করেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ১৭১৭; সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৩১৭)।
চ. কোরবানির গোশত বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি:
কোরবানির গোশত বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ কমে আসে। একে অপরের বাড়িতে গোশত আদান-প্রদানের ফলে পারস্পরিক ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। দরিদ্র মানুষেরা এই সময় সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পায়, তা তাদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।
কোরবানির দিন (ঈদ-উল-আযহা) ও তৎপরবর্তী দিনগুলোর (আইয়্যামে তাশরীক) আমল ও সুন্নাহসমূহ
ঈদ-উল-আযহা শুধুমাত্র পশু কোরবানি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এই দিন এবং এর পরবর্তী দিনগুলোতে (আইয়্যামে তাশরীক) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল ও সুন্নাহ রয়েছে, যা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বরকতময়।
ক. ঈদের দিনের সুন্নাহ:
ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, গোসল করা, উত্তম পোশাক পরিধান, সুগন্ধি ব্যবহার (পুরুষদের জন্য), ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু না খাওয়া, ঈদগাহে এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফেরা, তাকবীর বলা। ঈদ-উল-আযহার দিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো: ১. সকালে ঘুম থেকে ওঠা: ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা। ২. গোসল করা ও পবিত্রতা অর্জন: ঈদের নামাজের জন্য গোসল করা সুন্নাত। ৩. উত্তম পোশাক পরিধান: সাধ্য অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো ও পরিষ্কার পোশাক পরিধান করা। নতুন পোশাক হওয়া জরুরি নয়, তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উত্তম পোশাক হতে হবে। ৪. সুগন্ধি ব্যবহার (পুরুষদের জন্য): পুরুষদের জন্য সুগন্ধি বা আতর ব্যবহার করা সুন্নাত। ৫. ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু না খাওয়া: ঈদ-উল-ফিতরের সুন্নাত হলো ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করা, কিন্তু ঈদ-উল-আযহার সুন্নাত হলো ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে নিজের কোরবানির গোশত দিয়ে প্রথম খাবার গ্রহণ করা (যদি কোরবানি করা হয়)। যদি কোরবানি না করা হয়, তবে সাধারণ নিয়ম প্রযোজ্য। ৬. তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া: ঈদগাহের দিকে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে তাকবীর (তাকবীরে তাশরীক) বলা। ৭. এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফেরা: ঈদগাহে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা ব্যবহার করা এবং ফেরার সময় অন্য রাস্তা ব্যবহার করা সুন্নাত। এর মাধ্যমে বেশি সংখ্যক মানুষের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয় এবং রাস্তার দুই পাশের ফেরেশতারা সাক্ষ্য দেয়। ৮. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া উত্তম।
খ. ঈদের নামাজ:
নিয়ম ও গুরুত্ব। ঈদের নামাজ ওয়াজিব (ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর মতে) অথবা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (অন্যান্য ইমামগণের মতে)। এটি বছরে দু’বার মুসলমানদের বৃহৎ জামাতে একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ঈদের নামাজ সাধারণত খোলা ময়দানে বা বড় মসজিদে আদায় করা হয়। এটি দুই রাকাত এবং এতে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবীর রয়েছে (প্রথম রাকাতে সানা ও তাকবীরে তাহরীমার পর তিনটি এবং দ্বিতীয় রাকাতে রুকুর আগে তিনটি)। ঈদের খুতবা নামাজের পরে দেওয়া হয়, যা শোনা ওয়াজিব।
গ. তাকবীরে তাশরীক:
যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পঠিতব্য। তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। এটি যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসরের নামাজ পর্যন্ত (মোট ২৩ ওয়াক্ত) প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার পাঠ করতে হয়। জামাতে নামাজ আদায়কারী এবং একাকী নামাজ আদায়কারী উভয়ের জন্যই এটি প্রযোজ্য।
- i. তাকবীরে তাশরীকের আরবি, উচ্চারণ ও অর্থ:
- আরবি: اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إلَهَ إلَّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، وَلِلَّهِ الْحَمْدُ.
- বাংলা উচ্চারণ: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।”
- বাংলা অর্থ: “আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই; এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ; আর সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।”
- ii. নারী-পুরুষ সকলের জন্য এর বিধান: এই তাকবীর পুরুষরা উচ্চস্বরে এবং মহিলারা নিম্নস্বরে পাঠ করবেন। ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই এই তাকবীর পাঠ করা উচিত।
ঘ. আইয়্যামে তাশরীকে (কোরবানির দিনসহ পরবর্তী তিন দিন) খাওয়া-দাওয়া, আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া আদায় করার গুরুত্ব:
এই দিনগুলোতে রোজা রাখা নিষিদ্ধ। কোরবানির দিন (১০ই যিলহজ্জ) এবং এর পরবর্তী তিন দিনকে (১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ) ‘আইয়্যামুত তাশরীক’ বা তাশরীকের দিনসমূহ বলা হয়। এই দিনগুলো হলো খাওয়া-দাওয়া, আল্লাহর জিকির (স্মরণ) এবং তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করার দিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “তাশরীকের দিনগুলো হলো খাওয়া, পান করা এবং আল্লাহ তা’আলার জিকির করার দিন।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৪১)। এই দিনগুলোতে (অর্থাৎ, যিলহজ্জের ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখে) রোজা রাখা হারাম বা নিষিদ্ধ।
কোরবানির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর প্রতি সমর্পণের শিক্ষা
কোরবানি কেবল একটি পশু জবাইয়ের নাম নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা।
ক. কোরবানির মূল স্পিরিট:
আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণ। কোরবানির মূল চেতনা বা স্পিরিট হলো মহান আল্লাহর আদেশের সামনে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে আল্লাহর নির্দেশে কোরবানি করতে প্রস্তুত হওয়ার মাধ্যমে এই আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। মুসলমানরাও প্রতি বছর কোরবানির মাধ্যমে সেই ত্যাগের মহিমাকে স্মরণ করে এবং নিজেদের জীবনে আল্লাহর সকল আদেশের প্রতি অনুরূপ আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য অনুপ্রাণিত হয়।
খ. পশু কোরবানির প্রতীকী তাৎপর্য:
নিজের অভ্যন্তরীণ পশুত্ব (অহংকার, লোভ, হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদি বদ স্বভাব) কোরবানি করার শিক্ষা। পশু কোরবানির পাশাপাশি কোরবানির প্রতীকী তাৎপর্য হলো নিজের ভেতরের পশুসুলভ প্রবৃত্তিগুলোকে কোরবানি করা। মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা অহংকার, দম্ভ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ এবং অন্যান্য বদ স্বভাবগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করার শিক্ষাই কোরবানির অন্যতম প্রধান বার্তা। যেমনভাবে পশুর গলায় ছুরি চালানো হয়, তেমনি নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তিগুলোর উপর ছুরি চালিয়ে সেগুলোকে দমন করতে হবে।
গ. ইখলাস বা একনিষ্ঠতার গুরুত্ব:
শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করা। যেকোনো ইবাদতের প্রাণ হলো ইখলাস বা একনিষ্ঠতা। কোরবানিও এর ব্যতিক্রম নয়। লোকদেখানো, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি বা অন্য কোনো পার্থিব উদ্দেশ্যে কোরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর নির্দেশ পালনের ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে কোরবানি করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৭)।
ঘ. কোরবানির মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়া ও আল্লাহর নৈকট্য পরবর্তী জীবনে ধরে রাখার প্রচেষ্টা:
কোরবানির মাধ্যমে যে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জিত হয়, তা যেন শুধু কোরবানির দিনগুলোতেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সারা জীবন এই তাকওয়া অন্তরে ধারণ করে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর যে নৈকট্য অনুভূত হয়, তা অন্যান্য ইবাদত ও ভালো কাজের মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
ঙ. আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা:
কোরবানি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের একটি মাধ্যম। আল্লাহ যে আমাদেরকে সামর্থ্য দিয়েছেন, তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমরা তাঁর নামে পশু উৎসর্গ করি। পাশাপাশি, কোরবানির গোশত বণ্টনের মাধ্যমে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। এটি আমাদেরকে আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি সদয় ও দায়িত্বশীল হতে শিক্ষা দেয়।
কোরবানি সংক্রান্ত কিছু আধুনিক জিজ্ঞাসা, ভুল ধারণা ও তার শরয়ী সমাধান
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কোরবানি সংক্রান্ত কিছু নতুন প্রশ্ন ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। পাশাপাশি, সমাজে কিছু ভুল ধারণাও প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর শরয়ী সমাধান জানা আবশ্যক।
ক. প্রবাসী বা দূরে অবস্থানরত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানি আদায়ের বিভিন্ন পদ্ধতি (যেমন: নিজে না পারলে প্রতিনিধি নিয়োগ, বিভিন্ন সংস্থা বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানি – এগুলোর শরয়ী বৈধতা ও সতর্কতা):
যদি কোনো ব্যক্তি বিদেশে থাকেন বা অন্য কোনো কারণে নিজে উপস্থিত থেকে কোরবানি করতে অপারগ হন, তবে তিনি অন্য কোনো ব্যক্তিকে তার পক্ষ থেকে কোরবানি করার জন্য প্রতিনিধি (ওয়াকীল) নিয়োগ করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ জায়েজ। প্রতিনিধি নিজ দেশে বা প্রবাসীর কথামতো অন্য কোনো স্থানে তার নামে কোরবানি আদায় করতে পারবেন।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানির টাকা পাঠিয়ে দিলে তারা কোরবানি সম্পন্ন করে থাকেন। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যে সংস্থা বা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানি করা হচ্ছে, তাদের নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা এবং শরীয়ার নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন পশুর বয়স, শারীরিক ত্রুটিমুক্ততা, জবাইয়ের সঠিক পদ্ধতি, সময়মতো (কোরবানির দিনগুলোতে) জবাই করা এবং গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে শরীয়ার বিধান অনুসরণ করেন, সে বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, ওয়াজিব কোরবানি আদায় না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
খ. কোরবানির পশুর ছবি তোলা বা প্রদর্শনীর মানসিকতা বনাম ইখলাস:
কোরবানির পশু কেনার পর তার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা বা লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে প্রদর্শন করা ইখলাসের পরিপন্থী। কোরবানি একটি ইবাদত এবং তা করতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। যদি ছবি তোলা বা প্রচারের উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া প্রকাশ করা বা অন্যদের উৎসাহিত করা, এবং এতে কোনো প্রকার অহংকার বা লোকদেখানোর উদ্দেশ্য না থাকে, তবে তা ভিন্ন বিষয়। তবে, এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকাই অধিকতর নিরাপদ, যাতে মনের মধ্যে রিয়া বা লোকদেখানো ভাব প্রবেশ করতে না পারে।
গ. কোরবানি না করে সমপরিমাণ অর্থ গরিবদের মাঝে দান করা কি যথেষ্ট? (ওয়াজিব কোরবানির ক্ষেত্রে এর বিধান)। যার উপর কোরবানি ওয়াজিব, তার জন্য কোরবানি না করে সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি অর্থ গরিবদের মাঝে দান করে দিলে ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না। কারণ, কোরবানি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত, যেখানে নির্দিষ্ট পশু নির্দিষ্ট পন্থায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয় (রক্ত প্রবাহিত করা হয়)। অর্থ দান করা একটি ভিন্ন ইবাদত (সদকা)। একটি অন্যটির বিকল্প হতে পারে না। হ্যাঁ, নফল হিসেবে কেউ অর্থ দান করতে পারেন, কিন্তু ওয়াজিব কোরবানি আদায়ের জন্য পশু জবাই করতেই হবে। তবে, যদি কেউ কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানি করতে না পারেন এবং সময়ও পার হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে তিনি কোরবানির সমপরিমাণ অর্থ সদকা করে দেবেন, কিন্তু এটি কোরবানির স্থলাভিষিক্ত হবে না বরং এটি একটি কাফফারা হিসেবে গণ্য হবে।
ঘ. “যত বেশি দামি পশু, তত বেশি সওয়াব” – এই ধারণার শরয়ী বিশ্লেষণ (মূল বিষয় তাকওয়া ও ইখলাস):
আল্লাহর রাস্তায় খরচের ক্ষেত্রে উত্তম ও অধিক মূল্যবান বস্তু ব্যয় করার গুরুত্ব ইসলামে রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো ও হৃষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি করা প্রশংসনীয় এবং এতে বেশি সওয়াব পাওয়ার আশাও করা যায়, যদি নিয়ত বিশুদ্ধ থাকে। তবে, সওয়াবের মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া ও ইখলাস। খুব দামি পশু কোরবানি করা হলো কিন্তু তাতে লোকদেখানো বা অহংকারের উদ্দেশ্য থাকলো, তাহলে সেই কোরবানির কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই। পক্ষান্তরে, কম দামি পশুও যদি পূর্ণ ইখলাস ও তাকওয়ার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করা হয়, তবে তা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হতে পারে। সুতরাং, দামের চেয়ে নিয়তের বিশুদ্ধতা ও তাকওয়াই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
ঙ. কোরবানির বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার গুরুত্ব। ইসলাম পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার ধর্ম। কোরবানির পর পশুর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি ও অন্যান্য বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রেখে পরিবেশ দূষিত করা ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী এবং এটি একটি গুনাহের কাজ। এতে মানুষের কষ্ট হয় এবং রোগজীবাণু ছড়ায়। কোরবানির বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে গর্ত করে পুঁতে ফেলা অথবা সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের আঙ্গিনা ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।
কোরবানি সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা ও তার সংশোধন
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও, এ বিষয়ে সমাজে অজ্ঞতাবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক, যেন ইবাদতটি ত্রুটিমুক্তভাবে সম্পন্ন করা যায়।
ক. “বেশি দামি পশু কোরবানি দিলেই বেশি সওয়াব” – আলোচনা:
এই ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। নিঃসন্দেহে, আল্লাহর রাস্তায় সর্বোত্তম ও মূল্যবান জিনিস উৎসর্গ করা প্রশংসনীয় এবং এতে সওয়াব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি তা ইখলাস বা একনিষ্ঠতার সাথে করা হয়। তবে, সওয়াবের মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া ও ইখলাস। যদি লোকদেখানো বা অহংকার প্রকাশের জন্য বেশি দামি পশু কোরবানি করা হয়, তবে সেই কোরবানির সওয়াব বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পক্ষান্তরে, কম দামি পশুও যদি পূর্ণ ইখলাস, তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে কোরবানি করা হয়, তবে তা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মূল বিষয় হলো সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম পশু এবং বিশুদ্ধ নিয়ত।
খ. “অংশীদারের সংখ্যা বিজোড় হতে হবে” – আলোচনা:
এই ধারণার কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই। গরু, মহিষ বা উটে এক থেকে সাতজন পর্যন্ত যেকোনো সংখ্যক ব্যক্তি শরিক হতে পারেন, তা জোড় হোক বা বিজোড়। অর্থাৎ, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ বা ৭ জন শরিক হতে পারবেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রত্যেক শরিকের নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া এবং প্রত্যেকের অংশ যেন এক সপ্তমাংশের কম না হয়।
গ. “কোরবানির গোশত শুকানো যাবে না” বা “তিন দিনের বেশি রাখা যাবে না” – আলোচনা:
এই ধারণাও সঠিক নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে খাবারের অভাব থাকায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করতে নিষেধ করেছিলেন, যাতে দরিদ্ররা গোশত থেকে বঞ্চিত না হয়। পরবর্তীতে যখন স্বচ্ছলতা আসে, তখন তিনি এই নিষেধাজ্ঞা রহিত করে দেন এবং বলেন, “তোমরা খাও, জমা রাখো এবং দান করো।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৭১)। সুতরাং, বর্তমানে কোরবানির গোশত প্রয়োজন অনুযায়ী শুকিয়ে বা ফ্রিজে রেখে যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করা জায়েজ।
ঘ. “মৃত ব্যক্তির নামে কোরবানি দিলে নিজের নামে দেওয়া যায় না” – আলোচনা:
এটি একটি ভুল ধারণা। মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নফল কোরবানি করা জায়েজ এবং এটি একটি উত্তম কাজ। এর সওয়াব মৃত ব্যক্তি পাবেন বলে আশা করা যায়। নিজের ওয়াজিব কোরবানি আদায় করার পাশাপাশি সামর্থ্য থাকলে মৃত পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা অন্যান্যদের নামেও নফল কোরবানি করা যেতে পারে। এতে নিজের ওয়াজিব কোরবানি আদায়ে কোনো সমস্যা হয় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে কোরবানি করেছেন।
ঙ. “কোরবানির আগে নখ-চুল কাটা নিষেধ শুধু কোরবানিদাতার জন্য, পরিবারের সবার জন্য নয়” – সঠিক মাসআলা:
যিলহজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কোরবানি সম্পন্ন করা পর্যন্ত কোরবানিদাতার জন্য নিজের নখ, চুল ও শরীরের অন্যান্য পশম ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব (উত্তম)। এটি ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়। যদি কেউ কাটেন, তবে তার কোরবানির কোনো ক্ষতি হবে না, তবে একটি মুস্তাহাব আমল থেকে বঞ্চিত হবেন। এই হুকুম শুধুমাত্র যিনি কোরবানি করছেন তার জন্য প্রযোজ্য, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা কোরবানি করছেন না, তাদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যখন যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক শুরু হয় এবং তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করে, তখন সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে (বা শরীর থেকে কোনো পশম না ছিঁড়ে)।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৭৭)
কোরবানির দোয়া সম্পর্কিত প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
কোরবানি বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হলো:
১. কোরবানির প্রধান দোয়া কোনটি?
(উত্তর): জবাই করার ঠিক মুহূর্তে “بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ” (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার) বলা ওয়াজিব। এর আগে “ইন্নী ওয়াজ্জাহাতু…” দোয়াটি পড়া মুস্তাহাব।
২. কোরবানির দোয়া আরবিতে না পারলে বা ভুলে গেলে কী করব?
(উত্তর): যদি দীর্ঘ দোয়া মুখস্থ না থাকে, তবে শুধু “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে জবাই করলেই কোরবানি শুদ্ধ হবে। মূল বিষয় হলো বিশুদ্ধ নিয়ত এবং আল্লাহর নাম নেওয়া।
৩. নিজের কোরবানির পশু নিজে জবাই করা কি জরুরি?
(উত্তর): নিজের কোরবানি নিজে জবাই করা উত্তম ও সুন্নাহ। তবে নিজে করতে না পারলে বা অপারগ হলে অন্য কোনো যোগ্য মুসলমানকে দিয়েও জবাই করানো জায়েজ। সম্ভব হলে নিজে উপস্থিত থাকা ভালো।
৪. কোরবানির গোশত কতদিন পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে?
(উত্তর): কোরবানির গোশত প্রয়োজন অনুযায়ী যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করা জায়েজ। এতে কোনো বাধা নেই।
৫. মৃত ব্যক্তির নামে কি কোরবানি দেওয়া যায়? তার নিয়ম কী?
(উত্তর): হ্যাঁ, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নফল কোরবানি করা জায়েজ এবং এটি একটি সওয়াবের কাজ। এর জন্য আলাদা কোনো বিশেষ নিয়ম নেই, স্বাভাবিক কোরবানির মতোই সম্পন্ন করতে হবে এবং নিয়ত করার সময় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে করার নিয়ত করতে হবে।
৬. তাকবীরে তাশরীক কতদিন পড়তে হয়?
(উত্তর): যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত (মোট ২৩ ওয়াক্ত) প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব।
৭. কোরবানির চামড়ার টাকা কী করতে হবে?
(উত্তর): কোরবানির চামড়া নিজে ব্যবহার করা যায় অথবা তা কোনো দরিদ্র বা মিসকিনকে দান করে দেওয়া যায়। বিক্রি করলে বিক্রয়লব্ধ সম্পূর্ণ অর্থ দরিদ্র ও মিসকিনদের মধ্যে সদকা করে দিতে হবে। কসাই বা জবাইকারীকে পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া দেওয়া যাবে না।
৮. আকিকার সাথে কোরবানি দেওয়া যাবে কি?
(উত্তর): হ্যাঁ, হানাফী মাযহাব অনুযায়ী গরু, মহিষ বা উটের মতো শরিকানা জায়েজ এমন পশুতে কোরবানির সাথে আকিকার নিয়তেও অংশ নেওয়া জায়েজ আছে। তবে, প্রত্যেক শরিকের নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হতে হবে।
৯. কোরবানির পশুতে ৭ জনের কম শরিক হতে পারবে কি?
(উত্তর): হ্যাঁ, গরু, মহিষ বা উটে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারেন। সাতজনের কম, যেমন ২, ৩, ৪, ৫ বা ৬ জন মিলেও শরিক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ।
১০. কোরবানির দিনের আগে নখ ও চুল কাটার ব্যাপারে ইসলামের বিধান কী?
(উত্তর): যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করার আগ পর্যন্ত যিনি কোরবানি করার নিয়ত করেছেন, তার জন্য নিজের নখ, চুল বা শরীরের পশম না কাটা মুস্তাহাব (উত্তম), ওয়াজিব নয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য এই হুকুম প্রযোজ্য নয়।
১১. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কি কোরবানি দিতে পারবে?
(উত্তর): যদি ঋণ পরিশোধ করার পর নেসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট না থাকে, তবে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তবে, ঋণ থাকা সত্ত্বেও যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং কোরবানি দিলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা না হয়, তবে কোরবানি করা উচিত।
১২. কোরবানির সময় কখন শুরু ও শেষ হয়?
(উত্তর): কোরবানির সময় হলো যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। শহরাঞ্চলে ঈদের নামাজ আদায় হওয়ার আগে কোরবানি করা সহীহ নয়। তবে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদের জামাত হয় না, সেখানে ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পরও কোরবানি করা জায়েজ। রাতের বেলায় কোরবানি করা অনুত্তম, তবে করলে আদায় হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: মাসনুন দোয়া : দৈনন্দিন জীবনের জন্য নির্বাচিত দোয়া, ফজিলত ও আমলের পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা
উপসংহার
কোরবানি ইসলামে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার এক মহান নিদর্শন। এর প্রতিটি আমল গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। পশু নির্বাচন থেকে জবাইয়ের দোয়া (“বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” ও মাসনূন দোয়া), পশুকে কষ্ট না দেওয়া, যথাযথ গোশত বণ্টন এবং তাকবীরে তাশরীক পাঠ অপরিহার্য।
কোরবানির মূল শিক্ষা তাকওয়া অর্জন, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ ও ত্যাগ স্বীকার। এই চেতনা শুধু কোরবানির দিনেই নয়, সারা বছর আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। অন্যের প্রতি সহানুভূতি, দরিদ্রদের প্রতি দায়িত্ববোধ ও আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা।
পরিশেষে, আমরা আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের এই সামান্য ত্যাগ কবুল করেন, ত্রুটি ক্ষমা করেন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন। আমীন।
কোরবানির দোয়া : যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!