ওহমের সূত্র (Ohm’s Law): সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, সূত্রের প্রয়োগ ও সীমাবদ্ধতা

ওহমের সূত্র (Ohm's Law)
ওহমের সূত্র (Ohm's Law): সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, সূত্রের প্রয়োগ ও সীমাবদ্ধতা

ইলেক্ট্রনিক্স জগতের মূল ভিত্তি

আমাদের দৈনন্দিন জীবন—স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন থেকে শুরু করে ঘরের লাইট, ফ্যান পর্যন্ত—সবকিছুই ইলেক্ট্রনিক্সের এক অদৃশ্য জালের উপর নির্ভরশীল। এই জটিল জগতের অসংখ্য সার্কিট এবং যন্ত্রাংশের পেছনে রয়েছে কিছু মৌলিক নিয়ম বা সূত্র, যা এই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেই নিয়মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভিত্তিগত এবং গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি হলো ওহমের সূত্র (Ohm’s Law)

জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ সাইমন ওহম (Georg Simon Ohm) ১৮২৭ সালে এই যুগান্তকারী সূত্রটি প্রদান করেন, যা বিদ্যুৎ প্রবাহের তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি—ভোল্টেজ, কারেন্ট এবং রোধের মধ্যে এক সরল এবং সুন্দর গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সূত্রটি বোঝা ছাড়া ইলেক্ট্রনিক্সের জগতে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব।

এই আর্টিকেলে আমরা শুধুমাত্র ওহমের সূত্রের সংজ্ঞা মুখস্থ করব না, বরং এর প্রতিটি উপাদানকে ভেঙে ভেঙে দেখব। আমরা জানব ভোল্টেজ কী, কারেন্ট কী এবং রোধ কী। সহজ উপমা, গাণিতিক উদাহরণ, বাস্তব জীবনের প্রয়োগ এবং এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করব, যেন ইলেক্ট্রনিক্সের এই ভিত্তিগত অধ্যায়টি আপনার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। চলুন, বিদ্যুৎ প্রবাহের এই রহস্যময় জগতের দরজা খোলা যাক।


১. ওহমের সূত্রের তিনটি মূল স্তম্ভ: ভোল্টেজ, কারেন্ট ও রোধ

ওহমের সূত্র বোঝার আগে, আমাদের অবশ্যই বিদ্যুৎ প্রবাহের তিনটি প্রধান চরিত্রকে ভালোভাবে চিনতে হবে। একটি সহজ উপমা দিয়ে শুরু করা যাক: একটি পানির ট্যাংক থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

ক. ভোল্টেজ (Voltage, V): বৈদ্যুতিক চাপ

  • সংজ্ঞা: ভোল্টেজ হলো সেই বৈদ্যুতিক চাপ বা বল (Electromotive Force), যা একটি সার্কিটের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রনকে (চার্জ) প্রবাহিত হতে বাধ্য করে। ভোল্টেজ ছাড়া ইলেকট্রন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবে না, অর্থাৎ কারেন্ট প্রবাহিত হবে না।
  • পানির উপমা: পানির ট্যাংকে থাকা পানির উচ্চতাকে ভোল্টেজের সাথে তুলনা করুন। ট্যাংকে পানির উচ্চতা যত বেশি হবে, পাইপের মুখে পানির চাপও তত বেশি হবে। একইভাবে, একটি ব্যাটারির ভোল্টেজ যত বেশি, তার ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতাও তত বেশি।
  • একক: ভোল্টেজের একক হলো ভোল্ট (Volt), যাকে V দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

খ. কারেন্ট (Current, I): ইলেকট্রনের প্রবাহ

  • সংজ্ঞা: কারেন্ট হলো কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে প্রবাহিত মোট ইলেকট্রন বা চার্জের হার। সহজ কথায়, এটি হলো ইলেকট্রনের স্রোত।
  • পানির উপমা: পাইপের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তাকে কারেন্টের সাথে তুলনা করা যায়। চাপ (ভোল্টেজ) থাকলেও যদি পাইপের মুখ বন্ধ থাকে, তবে প্রবাহ (কারেন্ট) শূন্য হবে। সার্কিট সম্পূর্ণ হলেই কেবল কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
  • একক: কারেন্টের একক হলো অ্যাম্পিয়ার (Ampere), যাকে A দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর প্রতীক হলো I (Intensity থেকে)।

গ. রোধ (Resistance, R): প্রবাহের পথে বাধা

  • সংজ্ঞা: রোধ হলো কোনো পরিবাহীর একটি ধর্ম, যা তার মধ্য দিয়ে কারেন্ট বা ইলেকট্রনের প্রবাহকে বাধা দেয়। যে পদার্থের রোধ যত বেশি, তার মধ্য দিয়ে কারেন্ট তত কম প্রবাহিত হয়।
  • পানির উপমা: পাইপটি কতটা সরু বা চওড়া, সেটিই হলো রোধ। পাইপ যদি খুব সরু হয় (বেশি রোধ), তবে পানির চাপ (ভোল্টেজ) বেশি থাকলেও পানি প্রবাহের (কারেন্ট) হার কমে যাবে। অন্যদিকে, পাইপ চওড়া হলে (কম রোধ) পানি সহজে প্রবাহিত হতে পারবে।
  • একক: রোধের একক হলো ওহম (Ohm), যাকে গ্রিক অক্ষর Ω (ওমেগা) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

২. ওহমের সূত্রের মূল বক্তব্য ও গাণিতিক রূপ

এখন যেহেতু আমরা ভোল্টেজ, কারেন্ট এবং রোধ সম্পর্কে জানি, ওহমের সূত্র বোঝা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

ওহমের সূত্রের বিবৃতি:

“নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এবং অন্যান্য ভৌত অবস্থায়, কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহের মান (কারেন্ট) পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যের (ভোল্টেজের) সমানুপাতিক এবং এর রোধের ব্যস্তানুপাতিক।”

ব্যাখ্যা:

  • “বিভব পার্থক্যের সমানুপাতিক” এর অর্থ হলো, রোধ স্থির থাকলে ভোল্টেজ যত গুণ বাড়ানো হবে, কারেন্টও তত গুণ বাড়বে।
  • “রোধের ব্যস্তানুপাতিক” এর অর্থ হলো, ভোল্টেজ স্থির থাকলে রোধ যত গুণ বাড়ানো হবে, কারেন্ট তত গুণ কমে যাবে।

গাণিতিক রূপ: এই সম্পর্কটিকে একটি সরল সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, যা ইলেক্ট্রনিক্সের সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণগুলোর একটি:

V = I × R

যেখানে:

  • V = ভোল্টেজ (Volt)
  • I = কারেন্ট (Ampere)
  • R = রোধ (Ohm)

ওহমের সূত্রের ত্রিভুজ (Ohm’s Law Triangle): এই সূত্রটি মনে রাখার একটি জনপ্রিয় কৌশল হলো “ম্যাজিক ট্রায়াঙ্গেল”। এটি ব্যবহার করে আপনি V, I বা R যেকোনো একটির মান বের করতে পারবেন।

     V

     / \

    / _ \

   I   R

  • V বের করতে: I এবং R কে পাশাপাশি গুণ করুন (V = I × R)।
  • I বের করতে: V কে R দিয়ে ভাগ করুন (I = V / R)।
  • R বের করতে: V কে I দিয়ে ভাগ করুন (R = V / I)।

৩. গাণিতিক সমস্যার সমাধান (বাস্তব উদাহরণ)

চলুন, কয়েকটি সাধারণ গাণিতিক উদাহরণের মাধ্যমে ওহমের সূত্রের প্রয়োগ দেখি।

উদাহরণ ১: ভোল্টেজ নির্ণয়

  • সমস্যা: একটি সার্কিটে রোধের মান ৫ ওহম (Ω) এবং এর মধ্য দিয়ে ২ অ্যাম্পিয়ার (A) কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে। সার্কিটের ভোল্টেজ কত?
  • সূত্র: V = I × R
  • সমাধান: V = 2 A × 5 Ω = 10 V
  • উত্তর: সার্কিটের ভোল্টেজ হলো ১০ ভোল্ট।

উদাহরণ ২: কারেন্ট নির্ণয়

  • সমস্যা: একটি ১২ ভোল্টের (V) ব্যাটারির সাথে একটি ৬ ওহমের (Ω) রেজিস্টর যুক্ত করা হলো। সার্কিটে কত কারেন্ট প্রবাহিত হবে?
  • সূত্র: I = V / R
  • সমাধান: I = 12 V / 6 Ω = 2 A
  • উত্তর: সার্কিটে ২ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট প্রবাহিত হবে।

উদাহরণ ৩: রোধ নির্ণয়

  • সমস্যা: একটি ইলেক্ট্রিক হিটারে ২২০ ভোল্ট (V) সরবরাহ করা হলে এর মধ্য দিয়ে ১০ অ্যাম্পিয়ার (A) কারেন্ট প্রবাহিত হয়। হিটারের কয়েলের রোধ কত?
  • সূত্র: R = V / I
  • সমাধান: R = 220 V / 10 A = 22 Ω
  • উত্তর: হিটারের কয়েলের রোধ হলো ২২ ওহম।

৪. বাস্তব জীবনে ওহমের সূত্রের প্রয়োগ

ওহমের সূত্র শুধু পাঠ্যবইয়ের একটি নীরস অধ্যায় নয়, আমাদের চারপাশের প্রায় প্রতিটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রেই এর প্রয়োগ রয়েছে।

  • ফিউজ ও সার্কিট ব্রেকার: প্রতিটি ফিউজের একটি নির্দিষ্ট কারেন্ট রেটিং থাকে। শর্ট সার্কিটের সময় সার্কিটের রোধ হঠাৎ করে প্রায় শূন্য হয়ে যায়। ওহমের সূত্র (I = V/R) অনুযায়ী, রোধ কমে গেলে কারেন্ট প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত কারেন্টের তাপে ফিউজের তার গলে গিয়ে সার্কিট বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং আমাদের দামী যন্ত্রপাতিগুলোকে রক্ষা করে।
  • ফ্যানের রেগুলেটর ও লাইটের ডিমার: ফ্যানের স্পিড কমানো বা লাইটের আলো কমানোর জন্য যে রেগুলেটর বা ডিমার ব্যবহার করা হয়, তা মূলত একটি পরিবর্তনশীল রোধক (Variable Resistor)। যখন আমরা নবটি ঘুরিয়ে রোধ বাড়িয়ে দিই, তখন সার্কিটের কারেন্ট (I = V/R) কমে যায়, ফলে ফ্যান ধীরে ঘোরে বা লাইট কম আলো দেয়।
  • মোবাইল ফোন চার্জার: আপনার চার্জারের গায়ে লেখা থাকতে পারে 5V/2A। এর মানে হলো এটি ৫ ভোল্ট চাপে ২ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট সরবরাহ করতে পারে। ফোনের ভেতরের সার্কিটের রোধই নির্ধারণ করে এটি কী পরিমাণ কারেন্ট গ্রহণ করবে।
  • ইলেক্ট্রিক হিটার ও ইস্ত্রি: এসব যন্ত্রে উচ্চ রোধসম্পন্ন (High Resistance) নাইক্রোম তার ব্যবহার করা হয়। যখন এর মধ্য দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হয়, তখন উচ্চ রোধের কারণে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় (তাপ = I²R), যা আমরা কাজে লাগাই।

৫. ওহমের সূত্রের সীমাবদ্ধতা: কখন এই সূত্র কাজ করে না?

ওহমের সূত্রকে মৌলিক বলা হলেও এটি সার্বজনীন নয়। কিছু নির্দিষ্ট অবস্থায় বা কিছু নির্দিষ্ট ডিভাইসের ক্ষেত্রে এই সূত্রটি প্রযোজ্য হয় না।

আরও জানুন : রোধ কাকে বলে ? বিদ্যুৎ প্রবাহে রোধের ভূমিকা ও গুরুত্ব

৬. উপসংহার: এক সূত্রের জাদুকরী শক্তি

জর্জ সাইমন ওহমের এই সরল সূত্রটি প্রায় ২০০ বছর ধরে ইলেক্ট্রনিক্স এবং পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। এটি আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে বৈদ্যুতিক চাপ, প্রবাহ এবং বাধার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও সাধারণ সার্কিট বিশ্লেষণ, ডিজাইন এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ওহমের সূত্রের কোনো বিকল্প নেই। এটি শুধু একটি সমীকরণ নয়, এটি হলো বিদ্যুৎকে বোঝার এবং নিয়ন্ত্রণ করার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।


৭. প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

প্রশ্ন: ওহমের সূত্র কী? উত্তর: ওহমের সূত্র হলো বিদ্যুৎ প্রবাহের একটি মৌলিক সূত্র যা বলে, স্থির তাপমাত্রায় কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কারেন্ট (I) তার দুই প্রান্তের ভোল্টেজের (V) সমানুপাতিক এবং রোধের (R) ব্যস্তানুপাতিক। এর গাণিতিক রূপ: V = I × R।

প্রশ্ন: V, I এবং R দ্বারা কী বোঝানো হয়? উত্তর: V হলো ভোল্টেজ (বৈদ্যুতিক চাপ, একক: ভোল্ট), I হলো কারেন্ট (বিদ্যুৎ প্রবাহ, একক: অ্যাম্পিয়ার), এবং R হলো রোধ (প্রবাহে বাধা, একক: ওহম)।

প্রশ্ন: ওহমের সূত্র কেন গুরুত্বপূর্ণ? উত্তর: এটি যেকোনো বৈদ্যুতিক সার্কিটের ভোল্টেজ, কারেন্ট বা রোধের মান গণনা করতে সাহায্য করে। ইলেক্ট্রনিক্স ডিজাইন, সমস্যা সমাধান এবং নিরাপত্তা (যেমন: ফিউজ) নিশ্চিত করতে এই সূত্রটি অপরিহার্য।

প্রশ্ন: ওহমের সূত্র কি সকল ডিভাইসের জন্য প্রযোজ্য? উত্তর: না, এটি সকল ডিভাইসের জন্য প্রযোজ্য নয়। ডায়োড, ট্রানজিস্টরের মতো সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসগুলো (যাদের অ-ওহমিক ডিভাইস বলা হয়) এই সূত্র মেনে চলে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top