মোনাজাতের দোয়াসমূহ : কবুল হওয়ার শর্ত, আদব ও কোরআন-সুন্নাহর শ্রেষ্ঠ দোয়া

mybdhelp.com-মোনাজাতের দোয়াসমূহ
ছবি : MyBdhelp গ্রাফিক্স

মোনাজাত (مناجاة) – মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাথে বান্দার এক নিবিড়, আন্তরিক ও গোপন কথোপকথন। এটি এমন এক মুহূর্ত যখন বান্দা তার সকল চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, আকুতি-মিনতি ও কৃতজ্ঞতা সরাসরি তার সৃষ্টিকর্তার নিকট পেশ করে। মোনাজাত হলো দোয়ার এক বিশেষ রূপ, যেখানে বান্দার হৃদয় আল্লাহর ভয়ে ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকে এবং সে অত্যন্ত বিনয় ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য প্রার্থনা করে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে মোনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা এটি আল্লাহর সাথে বান্দার সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যম এবং ইবাদতের মগজস্বরূপ। এই প্রবন্ধে আমরা মোনাজাতের পরিচিতি, ইসলামে এর গুরুত্ব, মোনাজাত কবুল হওয়ার আবশ্যিক শর্তাবলী ও অন্তরায়সমূহ, মোনাজাতের সুন্নাহসম্মত আদব বা শিষ্টাচার, মোনাজাতের জন্য সর্বোত্তম সময় ও স্থান, পবিত্র কোরআন ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ থেকে নির্বাচিত মোনাজাতের দোয়াসমূহ (বাংলা অর্থ ও প্রেক্ষাপটসহ), জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিষয়ভিত্তিক দোয়া এবং মোনাজাতকে আরও হৃদয়গ্রাহী ও কার্যকর করার উপায় নিয়ে একটি বিস্তারিত ও প্রামাণিক আলোচনা উপস্থাপন করব, ইনশাআল্লাহ। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, শ্রদ্ধেয় পাঠকগণ যেন মোনাজাতের সঠিক পদ্ধতি ও তাৎপর্য অনুধাবন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হন এবং তাঁদের জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারেন।

এই নিবন্ধে যা জানব

মোনাজাত কী? পরিচিতি, আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ এবং ইসলামে এর গুরুত্ব

মোনাজাত শব্দটি আমাদের মুসলিম সমাজে বহুল প্রচলিত, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করা প্রয়োজন।

ক. ‘মোনাজাত’ (مناجاة) শব্দের শাব্দিক অর্থ 

‘মোনাজাত’ একটি আরবি শব্দ, যার মূলধাতু হলো ‘নাজওয়া’ (نجوى)। এর আভিধানিক অর্থ হলো – গোপন কথোপকথন, কানে কানে কথা বলা, নিভৃতে আলাপ করা, অন্তরঙ্গ আলোচনা অথবা কোনো গোপন বিষয় প্রকাশ করা। অর্থাৎ, যেখানে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতি থাকে না, এমন একান্ত আলাপচারিতাকে ‘নাজওয়া’ বা ‘মোনাজাত’ বলা হয়।

খ. ইসলামী পরিভাষায় মোনাজাত 

ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, মোনাজাত বলতে বোঝায় – বান্দার পক্ষ থেকে অত্যন্ত বিনয়, নম্রতা, একাগ্রতা, চোখের অশ্রু (সম্ভব হলে) এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে নিভৃতে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের যাবতীয় অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, অনুতাপ ও ক্ষমা প্রার্থনা পেশ করা। এটি আল্লাহর সাথে বান্দার এক গভীর আত্মিক সংযোগ, যেখানে বান্দা তার রবের সামনে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয়।

গ. দোয়া ও মোনাজাতের সম্পর্ক ও পার্থক্য 

দোয়া (دعاء) একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যার অর্থ হলো ডাকা, প্রার্থনা করা বা কোনো কিছু চাওয়া। মোনাজাত দোয়ারই একটি বিশেষ ও উন্নততর রূপ। সকল মোনাজাতই দোয়া, কিন্তু সকল দোয়া মোনাজাতের পর্যায়ে পড়ে না। মোনাজাতের ক্ষেত্রে যে গভীর আন্তরিকতা, বিনয়, নম্রতা ও নিভৃত আলাপচারিতার ভাব থাকে, তা সাধারণ দোয়ায় ততটা নাও থাকতে পারে। মোনাজাত যেন দোয়ার প্রাণকেন্দ্র, যেখানে বান্দা তার হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি দিয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলে।

ঘ. পবিত্র কোরআনে মোনাজাতের প্রতি উৎসাহ ও আল্লাহর সাড়া দানের প্রতিশ্রুতি 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে দোয়া ও মোনাজাতের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি যে তাদের ডাকে সাড়া দেন, সেই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

  • আল্লাহ তা’আলা বলেন: “وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ” অর্থ: “আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) আমি তো কাছেই আছি। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে, যাতে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৬)। এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর নৈকট্য ও দোয়া কবুলের আশ্বাস দিয়েছেন।
  • অন্যত্র আল্লাহ বলেন: “وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ” অর্থ: “আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত (দোয়া) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা গাফির, আয়াত: ৬০)। এই আয়াতে দোয়াকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং দোয়া না করাকে অহংকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঙ. হাদিস শরীফে মোনাজাতের গুরুত্ব ও আল্লাহর নিকট এর প্রিয়তা 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মোনাজাত ও দোয়ার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর উম্মতকেও এর প্রতি উৎসাহিত করতেন।

  • রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ” অর্থাৎ, “দোয়াই হলো ইবাদত।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ২৯৬৯)।
  • অন্য এক হাদিসে তিনি বলেছেন: “আল্লাহর নিকট দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানিত কোনো বস্তু নেই।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ৩৩৭০)।
  • রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে চায় না (দোয়া করে না), আল্লাহ তার উপর রাগান্বিত হন।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ৩৩৭৩। এই হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কাছে দোয়া ও মোনাজাত অত্যন্ত প্রিয় এবং এটি বান্দার জন্য অপরিহার্য একটি আমল। মোনাজাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও নৈকট্য লাভে ধন্য হয়।

মোনাজাত কবুল হওয়ার শর্তাবলী ও অন্তরায়সমূহ

মোনাজাত করলেই তা কবুল হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। দোয়া বা মোনাজাত কবুল হওয়ার জন্য কিছু অপরিহার্য শর্ত রয়েছে, যা পূরণ করা আবশ্যক। পাশাপাশি কিছু বিষয় এমনও রয়েছে যা দোয়া কবুলের পথে অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

ক. কবুল হওয়ার প্রধান শর্তাবলী: 

মোনাজাত বা দোয়া কবুল হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি:

  • i. ইখলাস (একনিষ্ঠতা): মোনাজাত করতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, অন্য কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্য (যেমন: লোকদেখানো, খ্যাতি অর্জন) যেন এর পেছনে না থাকে। অন্তরের গভীর থেকে পূর্ণ ইখলাসের সাথে দোয়া করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • ii. আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস (ইয়াকিন): রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তোমরা আল্লাহর কাছে এমনভাবে দোয়া করো যেন তোমরা কবুল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখো।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ৩৪৭৯।
  • iii. হারাম উপার্জন ও খাদ্য বর্জন করা: দোয়া কবুলের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো হালাল উপার্জন ও হালাল খাদ্য গ্রহণ। যে ব্যক্তির রক্ত-মাংসে হারাম মিশ্রিত, তার দোয়া আল্লাহর দরবারে সহজে কবুল হয় না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যে দীর্ঘ সফর করে ধূলি-মলিন বেশে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারাই প্রতিপালিত হয়েছে, এমন ব্যক্তির দোয়া কীভাবে কবুল হবে? (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১০১৫)।
  • iv. দোয়ায় তাড়াহুড়ো না করা এবং হতাশ না হওয়া: দোয়া করে সাথে সাথেই ফল লাভের জন্য অস্থির হয়ে পড়া বা দোয়া কবুল হচ্ছে না ভেবে হতাশ হয়ে দোয়া ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “তোমাদের প্রত্যেকের দোয়া কবুল হয়, যতক্ষণ না সে তাড়াহুড়ো করে বলে যে, ‘আমি তো দোয়া করলাম, কিন্তু আমার দোয়া কবুল হলো না’।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৬৩৪০)।
  • v. মনোযোগ ও একাগ্রতা (হুজুরী ক্বলব): অমনোযোগী, উদাসীন বা গাফেল অন্তর নিয়ে দোয়া করলে তা কবুল হয় না। পূর্ণ মনোযোগ, একাগ্রতা ও অন্তরের উপস্থিতি সহকারে দোয়া করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা গাফেল অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।
  • vi. হালাল ও বৈধ বিষয়ে দোয়া করা: এমন কোনো বিষয়ে দোয়া করা যাবে না যা শরীয়তবিরোধী, গুনাহের কাজ অথবা যার মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হয়। সর্বদা ভালো ও কল্যাণকর বিষয়েই দোয়া করতে হবে।

খ. মোনাজাত কবুলের অন্তরায় বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ: 

কিছু কাজ ও অবস্থা রয়েছে যা মোনাজাত বা দোয়া কবুলের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এগুলো থেকে বেঁচে থাকা জরুরি:

  • i. হারাম ভক্ষণ ও হারাম উপার্জন: এটি দোয়া কবুলের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
  • ii. গাফেল বা অমনোযোগী অন্তর: উদাসীনভাবে দোয়া করলে তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না।
  • iii. গুনাহে লিপ্ত থাকা ও তওবা না করা: ক্রমাগত গুনাহ করতে থাকা এবং তা থেকে তওবা না করা দোয়া কবুলের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
  • iv. দোয়ায় সীমা লঙ্ঘন করা: যেমন এমন কিছু চাওয়া যা আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ইনসাফের পরিপন্থী, অথবা অন্যের ক্ষতি কামনা করা।
  • v. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ থেকে বিরত থাকা (সামগ্রিকভাবে): যে সমাজে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালিত হয় না, সেখানে মানুষের দোয়া কবুল না হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে।
  • vi. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা: এটি একটি কবিরা গুনাহ এবং দোয়া কবুলের পথে অন্তরায়।

এই শর্তগুলো পূরণ করে এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো থেকে বেঁচে থেকে মোনাজাত করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার প্রবল আশা করা যায়।

মোনাজাতের আদব বা শিষ্টাচারসমূহ

দোয়া বা মোনাজাত হলো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন। তাই, এই কথোপকথনের সময় কিছু আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলা উচিত, যা দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর প্রতি বান্দার সম্মান ও বিনয় প্রকাশ করে।

ক. পবিত্রতা অর্জন (ওজু করা, সম্ভব হলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া) 

দোয়া বা মোনাজাতের পূর্বে ওজু করে পবিত্রতা অর্জন করা একটি উত্তম আদব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ওজুর সাথে করতেন। সম্ভব হলে, দোয়ার আগে দুই রাকাত ‘সালাতুল হাজত’ বা সাধারণ নফল নামাজ আদায় করে নেওয়া যেতে পারে, যা দোয়া কবুলের জন্য সহায়ক।

খ. ক্বিবলামুখী হওয়া

ক্বিবলা হলো মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক এবং ইবাদতের দিক। দোয়ার সময় ক্বিবলামুখী হয়ে বসা বা দাঁড়ানো মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক সময় ক্বিবলামুখী হয়ে দোয়া করতেন, যেমন বদরের যুদ্ধের প্রাক্কালে।

গ. বিনয় ও নম্রতার সাথে দাঁড়ানো বা বসা

আল্লাহর সামনে দোয়া করার সময় অন্তরে এবং বাহ্যিকভাবে পূর্ণ বিনয়, নম্রতা ও হীনতা প্রকাশ করা উচিত। অহংকার বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দোয়া কবুলের পরিপন্থী। আল্লাহর অসীম ক্ষমতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও অসহায়ত্বের অনুভূতি নিয়ে দাঁড়ানো বা বসা।

ঘ. দোয়ার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা (হামদ) ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা 

যেকোনো দোয়ার শুরুতে প্রথমে মহান আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা (হামদ ও সানা) করা এবং এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা দোয়া কবুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদব ও শর্ত। হাদিসে এসেছে, যে দোয়া আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরুদ দ্বারা শুরু করা হয় না, তা আসমান পর্যন্ত পৌঁছায় না বা আটকে থাকে। (সুনান আত-তিরমিযী)।

ঙ. হাত তুলে দোয়া করা (বিভিন্ন পদ্ধতি ও তার প্রমাণ) 

হাত তুলে দোয়া করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ এবং দোয়া কবুলের একটি আদব। বিভিন্ন হাদিসে হাত তুলে দোয়া করার প্রমাণ পাওয়া যায়। উভয় হাত বুক বরাবর উঠিয়ে, হাতের তালু আসমানের দিকে রেখে দোয়া করা সাধারণ নিয়ম। ইস্তিস্কার (বৃষ্টির) দোয়ায় হাত আরও উঁচু করার কথাও হাদিসে এসেছে। তবে, কিছু নির্দিষ্ট দোয়ার ক্ষেত্রে (যেমন: নামাজের ভেতরের দোয়া) হাত তোলার প্রয়োজন নেই।

চ. মিনতিপূর্ণ ও কান্নার সুরে (সম্ভব হলে) দোয়া করা 

আল্লাহর কাছে দোয়া করার সময় অন্তরে পূর্ণ আকুতি, মিনতি এবং সম্ভব হলে কান্নার ভাব নিয়ে আসা উচিত। চোখের পানি আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী চোখ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।” (সুনান আত-তিরমিযী)। কান্নার সুরে, ভগ্ন হৃদয়ে দোয়া করলে তা আল্লাহর রহমত আকর্ষণ করে। যদি কান্না না আসে, তবে কান্নার ভান করা বা কান্নার চেষ্টা করাও প্রশংসনীয়।

ছ. নিজের গুনাহ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া 

দোয়ার মধ্যে নিজের কৃত গুনাহ ও ভুলত্রুটির জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে অকপটে স্বীকার করা এবং তার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা দোয়া কবুলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেমন হযরত ইউনুস (আঃ) বিপদে পড়ে দোয়া করেছিলেন: “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যা-লিমীন” (আপনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, আপনি পবিত্র এবং আমিই তো সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত)।

জ. আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ (আসমাউল হুসনা) ও তাঁর গুণাবলী উল্লেখ করে দোয়া করা 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সুন্দর নামসমূহের (আসমাউল হুসনা) মাধ্যমে দোয়া করতে বলেছেন: “وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا” অর্থ: “আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেই সকল নাম ধরেই ডাকো।” (সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ১৮০)। দোয়ার সময় প্রার্থিত বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী উল্লেখ করে (যেমন: ইয়া রাহমান, ইয়া রাহীম, ইয়া গাফূর, ইয়া রাযযাক) দোয়া করলে তা অধিক কার্যকর হয়।

ঝ. বারবার ও ধীরস্থিরভাবে দোয়া করা 

একবার দোয়া করেই ক্ষান্ত না হয়ে, বরং একই বিষয়ে বারবার, ধীরস্থিরভাবে এবং পূর্ণ আশা নিয়ে দোয়া করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনেক সময় তিনবার করে দোয়া করতেন। বারবার দোয়া করা আল্লাহর প্রতি বান্দার ঐকান্তিকতা ও নির্ভরতার প্রমাণ।

ঞ. দোয়ার শেষে পুনরায় আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করে “আমীন” বলা 

দোয়ার শুরুতে যেমন আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফ পাঠ করা হয়, তেমনি দোয়ার শেষেও আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূল (ﷺ)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করে “আমীন” (হে আল্লাহ! কবুল করুন) বলা মুস্তাহাব। এটি দোয়ার পূর্ণাঙ্গতা দান করে।

মোনাজাতের জন্য সর্বোত্তম সময় ও স্থান

কিছু বিশেষ সময় ও স্থান রয়েছে যখন দোয়া বা মোনাজাত কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। মুমিন বান্দার উচিত এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পরিমাণে দোয়া করা।

ক. সর্বোত্তম সময়সমূহ: 

ইসলামী শরীয়তে দোয়া কবুলের জন্য কিছু বিশেষ সময়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে:

  • i. রাতের শেষ তৃতীয়াংশ (তাহাজ্জুদের সময়): রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আমাদের রব আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন: কে আছে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আছে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব? কে আছে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ১১৪৫)। এই সময় দোয়া কবুলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • ii. ফরজ নামাজের পর: প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া কবুল হয় বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ৩৪৯৯)।
  • iii. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না (অর্থাৎ কবুল হয়)।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৫২১; তিরমিযী)।
  • iv. জুমুআর দিনে বিশেষ মুহূর্ত: জুমুআর দিনে এমন একটি সময় আছে যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায়, আল্লাহ তাকে তাই দান করেন। এই সময়টি সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে, তবে আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অথবা ইমাম খুতবার জন্য মিম্বরে বসা থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিকে অধিক সম্ভাবনাময় মনে করা হয়।
  • v. সেজদারত অবস্থায়: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় যখন সে সেজদারত থাকে। সুতরাং, তোমরা সেজদায় বেশি বেশি দোয়া করো।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৪৮২)।
  • vi. রমজান মাসে, বিশেষত লাইলাতুল কদরে: রমজান মাস দোয়া কবুলের বিশেষ মাস। এই মাসে ইফতারের সময়, সেহরির সময় এবং বিশেষ করে মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদরে দোয়া কবুল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
  • vii. আরাফাতের দিনে: হজের সময় আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালে দোয়া কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো আরাফাতের দিনের দোয়া।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ৩৫৮৫)।
  • viii. বৃষ্টি বর্ষণের সময়: বৃষ্টি আল্লাহর রহমত এবং এই সময় দোয়া কবুল হয় বলে হাদিসে ইঙ্গিত রয়েছে।
  • ix. অসুস্থ অবস্থায় বা বিপদগ্রস্ত অবস্থায়: বিপদগ্রস্ত ও অসুস্থ ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ বিশেষভাবে কবুল করেন, যদি সে ধৈর্য ধারণ করে ও আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল থাকে।

খ. গ্রহণযোগ্য স্থানসমূহ: 

যদিও আল্লাহ তা’আলা সর্বত্র বিরাজমান এবং যেকোনো স্থান থেকেই দোয়া করা যায়, তবুও কিছু স্থানের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে যেখানে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে:

  • i. মসজিদসমূহ, বিশেষত মসজিদুল হারাম (কা’বা শরীফ), মসজিদে নববী (মদীনা শরীফ), বাইতুল মুকাদ্দাস (আল-আকসা মসজিদ): এই মসজিদগুলো অত্যন্ত পবিত্র এবং এখানে ইবাদত ও দোয়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
  • ii. পবিত্র স্থানসমূহ (যেমন: আরাফাত, মুযদালিফা, মিনা, সাফা-মারওয়া পাহাড়, মুলতাযাম, মাকামে ইবরাহীম): হজের সময় এই স্থানগুলোতে দোয়া কবুল হয়।
  • iii. নির্জন ও পবিত্র যেকোনো স্থান যেখানে মনোযোগ থাকে: ঘরের কোনো নির্জন কোণে বা এমন কোনো পবিত্র স্থানে যেখানে পূর্ণ মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে আল্লাহর জিকির ও দোয়া করা যায়, সেখানেও দোয়া কবুল হওয়ার আশা করা যায়। মূল বিষয় হলো অন্তরের উপস্থিতি ও আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন।

পবিত্র কোরআন থেকে নির্বাচিত মোনাজাতের শ্রেষ্ঠ দোয়াসমূহ (বাংলা অর্থ ও প্রেক্ষাপটসহ)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা নিজেই আমাদেরকে দোয়া করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন এবং বিভিন্ন নবী-রাসূল ও নেককার বান্দাদের অসংখ্য দোয়া উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের জন্য মোনাজাতের উত্তম নমুনা। এই দোয়াগুলো অত্যন্ত অর্থবহ, ব্যাপক এবং আল্লাহর নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য।

ক. হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) এর দোয়া (ক্ষমা প্রার্থনার): 

জান্নাতে নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের পর যখন হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন, তখন তাঁরা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে এই ভাষায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন:

  • আরবি: رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকূনান্না মিনাল খাসিরীন।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।” (সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ২৩)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: এটি মানবজাতির প্রথম তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া। এতে নিজের অপরাধ স্বীকার এবং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার প্রতি পূর্ণ নির্ভরতা প্রকাশ পেয়েছে। যেকোনো গুনাহের পর এই দোয়া পাঠ করা অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

খ. হযরত নূহ (আঃ) এর দোয়া (বিপদ থেকে মুক্তির): 

হযরত নূহ (আঃ) তাঁর কাওমের অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে এবং মহাপ্লাবনের পূর্বে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন:

  • আরবি: رَّبِّ أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانتَصِرْ
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বি আন্নী মাগলূবুন ফানতাসির।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো পরাজিত (অসহায়), সুতরাং আপনিই প্রতিশোধ (বা সাহায্য) গ্রহণ করুন।” (সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ১০)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: চরম অসহায়ত্ব ও বিপদের মুহূর্তে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য এটি একটি শক্তিশালী দোয়া। যখন সকল উপায় নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করা যায়।

গ. হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর দোয়া (সন্তান ও উম্মাহর জন্য): 

হযরত ইবরাহীম (আঃ) নিজের জন্য, তাঁর সন্তানদের জন্য এবং সমগ্র উম্মাহর কল্যাণের জন্য অসংখ্য দোয়া করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দোয়া:

  • আরবি (নামাজ প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমা প্রার্থনার জন্য): رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ (৪০) رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ (৪১)
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বিজ’আলনী মুক্বীমাস সালাতি ওয়া মিন যুররিইয়্যাতী, রাব্বানা ওয়া তাক্বাব্বাল দু’আ। রাব্বানাগফির লী ওয়া লিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াক্বূমুল হিসাব।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী করুন এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও। হে আমাদের প্রতিপালক! আর আমার দোয়া কবুল করুন। হে আমাদের প্রতিপালক! যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সকল মুমিনকে ক্ষমা করুন।” (সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০-৪১)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: এই দোয়াটি নিজেদের ও সন্তানদের দ্বীনের উপর অটল থাকা, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং সকলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার এক চমৎকার নমুনা।

ঘ. হযরত মূসা (আঃ) এর দোয়া (সাহায্য ও জ্ঞান প্রার্থনার): 

হযরত মূসা (আঃ) বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। যেমন, ফেরাউনের কাছে যাওয়ার পূর্বে তিনি বলেছিলেন:

  • আরবি (বক্ষ প্রশস্তকরণ ও কাজ সহজ করার জন্য): قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي (২৫) وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي (২৬) وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي (২৭) يَفْقَهُوا قَوْلِي (২৮)
  • বাংলা উচ্চারণ: ক্বালা রাব্বিশরাহলী সাদরী। ওয়া ইয়াসসির লী আমরী। ওয়াহলুল ‘উক্বদাতাম মিল লিসানী। ইয়াফক্বাহূ ক্বাওলী।
  • বাংলা অর্থ: “(মূসা) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দিন। আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ২৫-২৮)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: যেকোনো কঠিন কাজ বা দায়িত্ব পালনের পূর্বে আল্লাহর কাছে সাহায্য, মনের প্রশান্তি এবং বাকপটুতা লাভের জন্য এই দোয়া অত্যন্ত কার্যকর।

ঙ. হযরত আইয়ুব (আঃ) এর দোয়া (রোগমুক্তির): দীর্ঘদিন কঠিন রোগে আক্রান্ত থাকার পর হযরত আইয়ুব (আঃ) অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে আরোগ্য প্রার্থনা করেছিলেন:

  • আরবি: أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
  • বাংলা উচ্চারণ: আন্নী মাসসানিয়াদ দুররু ওয়া আনতা আরহামুর রাহিমীন।
  • বাংলা অর্থ: “(হে আমার রব!) আমাকে দুঃখ-কষ্ট (রোগ) স্পর্শ করেছে, আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৮৩)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: রোগব্যাধি ও যেকোনো কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য পূর্ণ আশা ও বিনয়ের সাথে আল্লাহর রহমত কামনা করার এটি একটি উত্তম দোয়া।

চ. হযরত ইউনুস (আঃ) এর দোয়া (বিপদ থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ দোয়া – দোয়া ইউনুস): 

মাছের পেটে থাকাকালীন হযরত ইউনুস (আঃ) এই দোয়া পাঠ করেছিলেন, যার ওসিলায় আল্লাহ তাঁকে সেই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যেকোনো মুসলমান যদি কোনো বিপদে পড়ে এই দোয়া পাঠ করে, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন।

  • আরবি: لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
  • বাংলা উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যা-লিমীন।
  • বাংলা অর্থ: “আপনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, আপনি পবিত্র এবং আমিই তো সীমা লঙ্ঘনকারীদের (জালিমদের) অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: এই দোয়াটি ‘দোয়া ইউনুস’ নামে পরিচিত। এতে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি, তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা এবং নিজের অপরাধ ও দুর্বলতা স্বীকার করার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। যেকোনো বিপদ, দুশ্চিন্তা ও সংকট থেকে মুক্তির জন্য এই দোয়া অত্যন্ত শক্তিশালী।

ছ. হযরত যাকারিয়া (আঃ) এর দোয়া (নেক সন্তানের জন্য): 

বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের জন্য হযরত যাকারিয়া (আঃ) আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছিলেন:

  • আরবি: رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বি হাব লী মিল্লাদুনকা যুররিইয়্যাতান ত্বাইয়্যিবাহ, ইন্নাকা সামী’উদ দু’আ।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আপনার নিকট থেকে একটি পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া শ্রবণকারী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৮)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: নেক, صالح (সৎকর্মপরায়ণ) ও পবিত্র সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর কাছে এই দোয়া করা উচিত।

জ. জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া: 

আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই দোয়া করতে শিখিয়েছেন:

  • আরবি: وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
  • বাংলা উচ্চারণ: ওয়া ক্বুর রাব্বি যিদনী ‘ইলমা।
  • বাংলা অর্থ: “এবং বলুন, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” (সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১১৪)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: উপকারী জ্ঞান (ইলমে নাফে) অর্জনের জন্য এবং নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য সর্বদা এই দোয়া পাঠ করা উচিত।

ঝ. দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য جامع (ব্যাপক) দোয়া: 

এটি কোরআনে বর্ণিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও ব্যাপক অর্থবোধক দোয়া, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সবচেয়ে বেশি পাঠ করতেন:

  • আরবি: رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আযাবান নার।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে আগুনের (জাহান্নামের) শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০১)।
  • প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা: এই দোয়ায় দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রকার কল্যাণ (হাসানাহ) কামনা করা হয়েছে। ‘হাসানাহ’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক, যা সুস্বাস্থ্য, সচ্ছলতা, নেক স্ত্রী/স্বামী, সৎ সন্তান, উপকারী জ্ঞান, সম্মান, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, ক্ষমা, জান্নাত লাভ ইত্যাদি সকল কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে।

ঞ. ঈমানের উপর অটল থাকার দোয়া: 

হেদায়েত লাভের পর তার উপর অটল থাকা এবং অন্তর যেন বক্র না হয়ে যায়, সেজন্য এই দোয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

  • আরবি: رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা লা তুযিগ কুলূবানা বা’দা ইয হাদাইতানা ওয়া হাব লানা মিল্লাদুনকা রাহমাহ, ইন্নাকা আনতাল ওয়াহ্হাব।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে হেদায়েত দানের পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করে দেবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয়ই আপনিই মহান দাতা।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮)।

ট. পিতামাতার জন্য দোয়া: 

পিতামাতার জন্য দোয়া করা সন্তানের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোরআনে এই দোয়া শিখানো হয়েছে:

  • আরবি: رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
  • বাংলা উচ্চারণ: রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা।
  • বাংলা অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের (পিতামাতার) প্রতি দয়া করুন, যেমনভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।” (সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৪)।

এই কোরআনিক দোয়াগুলো মোনাজাতের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকর। এগুলো নিয়মিত পাঠ করা এবং এর অর্থ অনুধাবন করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি অবশ্যই সাড়া দেবেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সুন্নাহ থেকে মোনাজাতের জন্য নির্বাচিত হাদিসের দোয়াসমূহ (বাংলা অর্থসহ)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সর্বোত্তম দোয়া ও মোনাজাতকারী। তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে অসংখ্য দোয়া করেছেন এবং তাঁর উম্মতকেও সেই দোয়াগুলো শিখিয়েছেন। এই দোয়াগুলো আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়, ব্যাপক অর্থবোধক এবং দ্রুত কবুল হওয়ার আশা করা যায়। নিম্নে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া উল্লেখ করা হলো:

ক. সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া) 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই দোয়াটিকে ‘সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার’ বা ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সকালে এই দোয়া পাঠ করবে এবং ঐদিন সন্ধ্যার আগে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সন্ধ্যায় এই দোয়া পাঠ করবে এবং ঐদিন সকালের আগে মারা যাবে, সেও জান্নাতী হবে। (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৬৩০৬)।

  • আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَىٰ عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ।
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা আনতা রাব্বী লা ইলা-হা ইল্লা আনতা, খালাক্বতানী ওয়া আনা ‘আবদুকা, ওয়া আনা ‘আলা ‘আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাসতাত্বোয়া‘তু। আ‘ঊযুবিকা মিন শাররি মা সানা‘তু, আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়া, ওয়া আবূউ লাকা বিযাম্বী, ফাগফির লী, ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতা।
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনার বান্দা। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির উপর অবিচল রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উপর আপনার যে নেয়ামত রয়েছে, তা আমি স্বীকার করছি এবং আমার গুনাহও আমি আপনার নিকট স্বীকার করছি। সুতরাং, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা, আপনি ব্যতীত আর কেউই গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।”

খ. বিপদ, দুশ্চিন্তা ও ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া 

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদে এক ব্যক্তিকে (আবু উমামাহ রাঃ) অত্যন্ত চিন্তিত অবস্থায় দেখে তাকে এই দোয়াটি শিখিয়েছিলেন, যা পাঠ করলে আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন এবং ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবেন।

  • আরবি: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ।
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনাল ‘আজযি ওয়াল কাসাল, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখল, ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিন গালাবাতিদ দাইনি ওয়া ক্বাহরির রিজা-ল।
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে এবং ঋণের বোঝা ও মানুষের আধিপত্য (বা জবরদস্তি) থেকে।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৫৫)।

গ. জ্ঞান, রিযিক ও কবুল আমলের জন্য দোয়া (সকালের দোয়া) 

উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজরের নামাজের পর এই দোয়াটি পাঠ করতেন:

  • আরবি: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا، وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا।
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ‘ইলমান না-ফি‘আ, ওয়া রিযক্বান ত্বাইয়্যিবা, ওয়া ‘আমালান মুতাক্বাব্বালা।
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট উপকারী জ্ঞান, পবিত্র রিযিক এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৯২৫; মুসনাদে আহমাদ)।

ঘ. অন্তরকে দ্বীনের উপর স্থির রাখার দোয়া 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই দোয়াটি খুব বেশি পাঠ করতেন:

  • আরবি: يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ، ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَىٰ دِينِكَ।
  • বাংলা উচ্চারণ: ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূব, সাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দ্বীনিক।
  • বাংলা অর্থ: “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন।” (সুনান আত-তিরমিযী, হাদিস: ২১৪০, ৩৫২২)।

ঙ. সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনার দোয়া 

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই দোয়া পাঠ করতেন:

  • আরবি: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ، وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ।
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘ঊযুবিকা মিন শাররি মা ‘আমিলতু, ওয়া মিন শাররি মা লাম আ‘মাল।
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং যা আমি করিনি (অর্থাৎ, ভবিষ্যতে করতে পারি এমন অনিষ্টকর কাজ) তার অনিষ্ট থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৭১৬)।

চ. কল্যাণ কামনা ও অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাওয়ার جامع (ব্যাপক) দোয়া 

এটি একটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক দোয়া, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল প্রকার কল্যাণ কামনা করা হয়েছে এবং সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।

  • আরবি: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنَ الْخَيْرِ كُلِّهِ عَاجِلِهِ وَآجِلِهِ، مَا عَلِمْتُ مِنْهُ وَمَا لَمْ أَعْلَمْ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّرِّ كُلِّهِ عَاجِلِهِ وَآجِلِهِ، مَا عَلِمْتُ مِنْهُ وَمَا لَمْ أَعْلَمْ… (দোয়াটি আরও দীর্ঘ)
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিনাল খাইরি কুল্লিহী ‘আ-জিলিহী ওয়া আ-জিলিহ, মা ‘আলিমতু মিনহু ওয়া মা লাম আ‘লাম। ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনাশ শাররি কুল্লিহী ‘আ-জিলিহী ওয়া আ-জিলিহ, মা ‘আলিমতু মিনহু ওয়া মা লাম আ‘লাম…
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট সকল প্রকার কল্যাণ প্রার্থনা করছি, যা দ্রুত আগমনকারী (দুনিয়ার) এবং যা বিলম্বে আগমনকারী (আখিরাতের), যা আমি জানি এবং যা আমি জানি না। আর আমি আপনার নিকট সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা দ্রুত আগমনকারী এবং যা বিলম্বে আগমনকারী, যা আমি জানি এবং যা আমি জানি না…” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৮৪৬।

ছ. রোগ মুক্তির জন্য রাসূল (ﷺ) এর শেখানো দোয়া 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেলে বা নিজে অসুস্থ হলে এই দোয়া পাঠ করতেন:

  • আরবি: اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ، أَذْهِبِ الْبَأْسَ، اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا।
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা রাব্বান না-স, আযহিবিল বা’স, ইশফিহি (বা ইশফিহা – স্ত্রীলিঙ্গ হলে) ওয়া আনতাশ শা-ফী, লা শিফা-আ ইল্লা শিফা-উক, শিফা-আন লা ইউগা-দিরু সাক্বামা।
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ, মানুষের প্রতিপালক! কষ্ট দূর করে দিন, আরোগ্য দান করুন (তাকে), আপনিই তো আরোগ্য দানকারী। আপনার আরোগ্য ব্যতীত কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য দিন যা কোনো রোগ অবশিষ্ট রাখে না।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৫৭৪৩)।

জ. জান্নাত প্রার্থনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া

  • আরবি: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ أَوْ عَمَلٍ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ أَوْ عَمَلٍ…
  • বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া মা ক্বাররাবা ইলাইহা মিন ক্বাওলিন আও ‘আমাল। ওয়া আ‘ঊযুবিকা মিনান না-রি ওয়া মা ক্বাররাবা ইলাইহা মিন ক্বাওলিন আও ‘আমাল…
  • বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং এমন কথা ও কাজের তৌফিক প্রার্থনা করছি যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেবে। আর আমি আপনার নিকট জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং এমন কথা ও কাজ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা আমাকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করে দেবে…” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৮৪৬।

এই দোয়াগুলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অসংখ্য দোয়ার মধ্যে কয়েকটি মাত্র। হাদিসের কিতাবগুলোতে এমন আরও বহু মূল্যবান দোয়া সংকলিত রয়েছে, যা মোনাজাতের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

বিষয়ভিত্তিক মোনাজাতের দোয়া: জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে

কোরআন ও হাদিসের মাসনুন দোয়াগুলোর পাশাপাশি আমরা জীবনের বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করতে পারি। নিম্নে কিছু বিষয়ভিত্তিক দোয়ার ধারণা দেওয়া হলো, যা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে মাসনুন দোয়ার পাশাপাশি নিজের ভাষায়ও চাওয়া যেতে পারে।

ক. গুনাহ মাফ ও তওবার জন্য দোয়া: 

গুনাহ মাফ ও আল্লাহর ক্ষমা লাভ জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া। সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার ছাড়াও কোরআন ও হাদিসের অন্যান্য ইস্তেগফার (যেমন: “আসতাগফিরুল্লাহাল্লাযী লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম ওয়া আতুবু ইলাইহি”) পাঠ করা এবং নিজের ভাষায় অতীতের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। ভবিষ্যতে গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।

খ. হেদায়েত ও সঠিক পথের জন্য দোয়া: 

জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সঠিক পথের দিশা (হেদায়েত) এবং তার উপর অটল থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। দোয়া করা যেতে পারে: “হে আল্লাহ! আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন এবং তার উপর অবিচল রাখুন। আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন।” সূরা ফাতিহার “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাক্বীম” এই দোয়ারই অংশ।

গ. জ্ঞান বৃদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য দোয়া: 

উপকারী জ্ঞান (ইলমে নাফে) অর্জন এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কোরআনিক দোয়া “রাব্বি যিদনী ‘ইলমা” (হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন) পাঠ করা। এছাড়াও, “আল্লাহুম্মা ইনফ‘আনী বিমা ‘আল্লামতানী ওয়া ‘আল্লিম্নী মা ইয়ানফা‘উনী ওয়া যিদনী ‘ইলমা” (হে আল্লাহ! যা কিছু আমাকে শিখিয়েছেন তা দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন, যা আমার উপকারে আসবে তা আমাকে শিখিয়ে দিন এবং আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন) – এই দোয়াও পাঠ করা যেতে পারে।

ঘ. হালাল রিযিক ও বরকতের জন্য দোয়া: 

জীবিকা নির্বাহের জন্য হালাল ও পর্যাপ্ত রিযিকের প্রয়োজন। আল্লাহর কাছে প্রশস্ত, পবিত্র ও বরকতময় রিযিকের জন্য দোয়া করা। যেমন: “আল্লাহুম্মাকফিনী বিহালালিকা ‘আন হারামিক, ওয়া আগনিনী বিফাদলিকা ‘আম্মান সিওয়াক” (হে আল্লাহ! আপনার হালাল দ্বারা আমাকে হারাম থেকে বাঁচান এবং আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আপনি ব্যতীত অন্য সকলের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন)।

ঙ. রোগমুক্তি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া: 

নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের রোগমুক্তি ও সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত রোগমুক্তির দোয়াগুলো (যেমন: “আল্লাহুম্মা রাব্বান নাস…”) পাঠ করা এবং আরোগ্য লাভের জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা।

চ. বিপদ-আপদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য দোয়া: 

জীবনের যেকোনো বিপদ, মুসিবত, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় ও সাহায্য চাওয়া। দোয়া ইউনুস (“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যা-লিমীন”) এবং দুশ্চিন্তা মুক্তির অন্যান্য দোয়া পাঠ করা।

ছ. নেক সন্তান ও পরিবারে শান্তির জন্য দোয়া: 

নেককার, صالح (সৎকর্মপরায়ণ) সন্তান লাভের জন্য এবং পরিবারে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কোরআনে বর্ণিত হযরত যাকারিয়া (আঃ) ও হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর দোয়াগুলো পাঠ করা।

জ. মৃত ব্যক্তিদের জন্য (পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন) মাগফিরাতের দোয়া: 

মৃত পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং সকল মুমিন নর-নারীর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা (মাগফিরাত) ও রহমত কামনা করা। কোরআনিক দোয়া “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা” এবং জানাজার নামাজের দোয়াগুলো পাঠ করা যেতে পারে।

ঝ. ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ ও আখিরাতে সাফল্যের জন্য দোয়া: 

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঈমানের উপর অটল থাকা এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করার (হুসনুল খাতিমা) জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করা। আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, ক্ষমা, জান্নাত লাভ এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের জন্য সর্বদা দোয়া করা।

এই বিষয়গুলো ছাড়াও জীবনের যেকোনো প্রয়োজনে, যেকোনো সমস্যায় আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে, তিনিই একমাত্র সমাধানকারী।

মোনাজাতে নিজের ভাষায় দোয়া করা এবং এর গুরুত্ব

অনেক সময় মাসনুন আরবি দোয়াগুলো মুখস্থ না থাকার কারণে বা সেগুলোর অর্থ পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারার কারণে কেউ কেউ দোয়া করা থেকে বিরত থাকেন বা সংকোচ বোধ করেন। এই প্রসঙ্গে নিজের ভাষায় দোয়া করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ক. আরবি দোয়া মুখস্থ না থাকলে বা অর্থ না বুঝলে নিজের ভাষায় আন্তরিকভাবে দোয়া করার অনুমতি। 

ইসলাম একটি সহজ ও বাস্তবসম্মত ধর্ম। আল্লাহ তা’আলা বান্দার উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো বোঝা চাপিয়ে দেন না। যদি কারো আরবি দোয়া মুখস্থ না থাকে বা তিনি এর অর্থ বুঝতে না পারেন, তবে তিনি অবশ্যই তার নিজের মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারবেন। এর জন্য কোনো বাধা বা নিষেধাজ্ঞা নেই।

খ. নিজের ভাষায় মনের আকুতি ও আবেগ আল্লাহর কাছে তুলে ধরার সুবিধা। 

নিজের মাতৃভাষায় দোয়া করার একটি বড় সুবিধা হলো, এতে মনের আবেগ, আকুতি ও চাওয়াগুলো অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর কাছে তুলে ধরা যায়। অনেক সময় আরবি দোয়ার অর্থ না বোঝার কারণে সেই আবেগ বা আন্তরিকতা তৈরি হয় না, যা নিজের ভাষায় দোয়া করলে হয়। আল্লাহ চান বান্দা যেন তাঁর কাছে হৃদয়ের গভীর থেকে প্রার্থনা করে।

গ. আল্লাহ সকল ভাষা বোঝেন এবং অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। 

আল্লাহ তা’আলা সর্বজ্ঞানী ও সর্বশ্রোতা। তিনি সকল ভাষা বোঝেন এবং বান্দার অন্তরের প্রতিটি গোপন কথা সম্পর্কেও তিনি সম্যক অবগত। তাই, আপনি যে ভাষাতেই দোয়া করুন না কেন, যদি তা আন্তরিকতার সাথে হয়, তবে আল্লাহ অবশ্যই তা শোনেন এবং কবুল করার ক্ষমতা রাখেন। ভাষার ভিন্নতা দোয়া কবুলের পথে কোনো অন্তরায় নয়।

ঘ. তবে, কোরআন ও হাদিসের মাসনুন দোয়াগুলোর গুরুত্ব ও বরকত সর্বাধিক, তাই সেগুলো শিখে নেওয়ার চেষ্টা করা।

নিজের ভাষায় দোয়া করার অনুমতি থাকলেও, কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত মাসনুন দোয়াগুলোর গুরুত্ব, মর্যাদা ও বরকত নিঃসন্দেহে সর্বাধিক। কেননা, এই দোয়াগুলো স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা অথবা তাঁর প্রিয় রাসূল (ﷺ) শিখিয়েছেন। এগুলোর শব্দচয়ন, ভাব ও অর্থের গভীরতা অতুলনীয়। তাই, সাধ্য অনুযায়ী এই মাসনুন দোয়াগুলো আরবিতে শেখা, তার অর্থ অনুধাবন করা এবং সেগুলো দ্বারা দোয়া করার চেষ্টা করা উচিত।

ঙ. নিজের ভাষার দোয়ার সাথে মাসনুন দোয়ার সমন্বয় করা। 

সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো, প্রথমে কোরআন ও হাদিসের কিছু মাসনুন দোয়া (যা মুখস্থ আছে বা দেখে) পাঠ করা এবং এরপর নিজের ভাষায় নিজের প্রয়োজন ও মনের আকুতিগুলো আল্লাহর কাছে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা। এভাবে মাসনুন দোয়ার বরকত এবং নিজের ভাষার আন্তরিকতা – উভয়ের সমন্বয় ঘটবে, যা দোয়া কবুলের জন্য অধিক সহায়ক হতে পারে।

সম্মিলিত মোনাজাত: নিয়ম ও বিতর্ক 

সম্মিলিত মোনাজাত, বিশেষত ফরজ নামাজের পর ইমাম ও মুক্তাদিদের একত্রে হাত তুলে দোয়া করা, আমাদের এই অঞ্চলের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) মুসলিম সমাজে একটি বহুল প্রচলিত আমল। তবে, এর শরয়ী ভিত্তি ও নিয়ম নিয়ে আলেমগণের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে, যা জানা থাকা প্রয়োজন।

ক. সম্মিলিত মোনাজাতের প্রচলন ও এর বিভিন্ন রূপ 

সম্মিলিত মোনাজাত সাধারণত দেখা যায়:

  • পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে।
  • জুমুআ ও ঈদের নামাজের পর।
  • বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সভা বা মাহফিলের শেষে।
  • বিশেষ কোনো বিপদ বা প্রয়োজনে সকলে একত্রে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময়। এই মোনাজাতগুলোতে সাধারণত ইমাম দোয়া পাঠ করেন এবং মুক্তাদিগণ “আমীন, আমীন” বলেন।

খ. এ বিষয়ে আলেমগণের বিভিন্ন মতামত ও দলীলের পর্যালোচনা (কখন জায়েজ, কখন বিদআত হওয়ার আশঙ্কা) 

সম্মিলিত মোনাজাতের বৈধতা নিয়ে আলেমগণের মধ্যে প্রধানত দুটি ধারার মতামত পাওয়া যায়:

  • একদল আলেম: তাঁরা ফরজ নামাজের পর ইমাম ও মুক্তাদির সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দোয়া করাকে বিদআত (দ্বীনে নতুন সংযোজন) হিসেবে গণ্য করেন, কেননা তাঁদের মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফরজ নামাজের পর এভাবে নিয়মিত সম্মিলিত মোনাজাতের ব্যাপক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাঁরা বলেন, ফরজ নামাজের পর রাসূল (ﷺ) থেকে বিভিন্ন জিকির ও দোয়া বর্ণিত আছে, যা একাকী পাঠ করাই সুন্নাহ।
  • অন্য একদল আলেম: তাঁরা কিছু শর্তসাপেক্ষে এটিকে জায়েজ বা মুস্তাহাব (উত্তম) মনে করেন। তাঁদের মতে, দোয়া একটি ইবাদত এবং হাত তুলে দোয়া করাও সুন্নাহ। যখন ইমাম দোয়া করেন এবং মুক্তাদিগণ আমীন বলেন, তখন তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাঁরা কিছু সাধারণ দলীল (যেমন: দোয়ার সাধারণ নির্দেশ, সম্মিলিতভাবে ভালো কাজ করার গুরুত্ব) এবং কিছু বিশেষ ঘটনার (যেমন: ইস্তিস্কার নামাজে সম্মিলিত দোয়া) উপর ভিত্তি করে এর জায়েজের কথা বলেন। তবে, তাঁরাও এটিকে নামাজের অংশ বা অত্যাবশ্যকীয় মনে করাকে অপছন্দ করেন।

গ. রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল কিনা – একটি বিশ্লেষণ 

বিশুদ্ধ হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতির মতো নিয়মিত ও বাধ্যতামূলকভাবে সম্মিলিত মোনাজাতের ব্যাপক কোনো প্রচলন ছিল না। তাঁরা ফরজ নামাজের পর বিভিন্ন জিকির-আজকার ও ব্যক্তিগত দোয়া পাঠ করতেন। তবে, বিশেষ প্রয়োজনে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে দোয়া করেছেন এমন কিছু ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় (যেমন: বৃষ্টির জন্য দোয়া, যুদ্ধের ময়দানে দোয়া)।

ঘ. বিতর্কমুক্ত ও সুন্নাহসম্মত পন্থায় সম্মিলিতভাবে একে অপরের জন্য দোয়া করার গুরুত্ব 

যে বিষয়টি নিয়ে আলেমগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, সে বিষয়ে বাড়াবাড়ি বা বিভেদ সৃষ্টি করা উচিত নয়। তবে, বিতর্কমুক্ত ও সুন্নাহসম্মত পন্থায় একে অপরের জন্য দোয়া করার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। যেমন, কোনো ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করা, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা, সাধারণভাবে সকল মুসলমানের কল্যাণের জন্য দোয়া করা – এগুলো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। ইমাম সাহেব যদি দোয়া করেন এবং মুক্তাদিগণ স্বেচ্ছায় ও আন্তরিকভাবে “আমীন” বলেন, এবং এটিকে নামাজের অংশ মনে না করেন, তবে অনেক আলেম এটিকে নাজায়েজ বলেন না।

মোনাজাতকে আরও হৃদয়গ্রাহী ও কার্যকর করার উপায়

মোনাজাত শুধুমাত্র কিছু শব্দ উচ্চারণ বা হাত তোলার নাম নয়, বরং এটি আল্লাহর সাথে বান্দার এক গভীর আত্মিক কথোপকথন। এই কথোপকথনকে আরও হৃদয়গ্রাহী, আন্তরিক ও কার্যকর করার জন্য কিছু বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন:

ক. আল্লাহর মহত্ত্ব ও নিজের ক্ষুদ্রতা ও অসহায়ত্বের অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত রাখা। 

মোনাজাতের সময় মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতা, তাঁর বিশাল সৃষ্টিজগতের পরিচালনা, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গভীরতা এবং তাঁর সামনে নিজের অতি ক্ষুদ্রতা, দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতার অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত করা অত্যন্ত জরুরি। যখন বান্দা নিজেকে আল্লাহর সামনে একজন অভাবী ও অসহায় প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে, তখনই তার দোয়াতে প্রকৃত বিনয় ও আকুতি ফুটে উঠবে। এই অনুভূতি দোয়াকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

খ. নিজের কৃত গুনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া। 

আল্লাহর সামনে দোয়া করার আগে নিজের কৃত গুনাহ ও ভুলত্রুটিগুলোর জন্য আন্তরিকভাবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া উচিত। গুনাহের কারণে অন্তরে যে কালিমা পড়ে, তা দোয়া কবুলের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। তাই, মোনাজাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নিজের গুনাহ স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং ভবিষ্যতে সেই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। অনুতপ্ত হৃদয়ের দোয়া আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।

গ. আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার প্রতি পূর্ণ আশা রাখা, নিরাশ না হওয়া। 

যদিও আমরা গুনাহগার ও ত্রুটিপূর্ণ, তবুও আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা তাঁর গজবের চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত। তাই, মোনাজাত করার সময় আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার প্রতি পূর্ণ আশা রাখতে হবে। কখনো এই চিন্তা করা উচিত নয় যে, “আমার মতো গুনাহগারের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন না।” এমন চিন্তা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার শামিল, যা একটি বড় গুনাহ। দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আমি যত বড় পাপীই হই না কেন, আল্লাহ চাইলে আমাকে ক্ষমা করতে পারেন এবং আমার দোয়া কবুল করতে পারেন।

ঘ. দুনিয়াবী চাওয়ার পাশাপাশি আখিরাতের কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া। 

মোনাজাতে আমরা আমাদের দুনিয়াবী প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর কাছে চাইব, এটা স্বাভাবিক। তবে, একজন মুমিনের দৃষ্টি শুধুমাত্র দুনিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। দুনিয়াবী চাওয়ার পাশাপাশি আখিরাতের কল্যাণ, যেমন – ঈমানের সাথে মৃত্যু, কবরের আজাব থেকে মুক্তি, হাশরের ময়দানে আল্লাহর রহমত, জাহান্নাম থেকে নাজাত এবং জান্নাত লাভ – এই বিষয়গুলোকে দোয়ায় অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কেননা, আখিরাতের জীবনই হলো চিরস্থায়ী জীবন।

ঙ. শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, পিতামাতা, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সকল মুসলিম উম্মাহ এবং মানবজাতির কল্যাণের জন্য দোয়া করা। 

মোনাজাতের সময় শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং নিজের পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, জীবিত ও মৃত সকল মুমিন নর-নারী এবং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ ও হেদায়েতের জন্য দোয়া করা একটি মহৎ গুণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দোয়ায় সকল উম্মতের জন্য কল্যাণ কামনা করতেন। অন্যের জন্য দোয়া করলে ফেরেশতারা সেই দোয়াকারীর জন্যও অনুরূপ দোয়া করেন, যা দোয়া কবুলের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়।

চ. দোয়া কবুলের জন্য তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করা। 

দোয়া করার পর তার ফল লাভের জন্য তাড়াহুড়ো করা বা অধৈর্য হয়ে পড়া উচিত নয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী সঠিক সময়ে এবং সঠিক পন্থায় দোয়া কবুল করেন। কখনো কখনো তিনি বান্দার জন্য যা উত্তম মনে করেন, সেভাবেই দোয়া কবুল করেন, যা হয়তো বান্দার প্রার্থিত বিষয়ের চেয়েও কল্যাণকর। তাই, দোয়া করে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে এবং দোয়া চালিয়ে যেতে হবে। (দোয়া কবুলের তিনটি পদ্ধতি সম্পর্কিত হাদিস পরবর্তী অংশে আলোচিত হবে)।

মোনাজাতের পর করণীয় ও আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা

মোনাজাত করার পর একজন মুমিনের কিছু করণীয় রয়েছে এবং আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা তার ঈমানের পরিচায়ক।

ক. দোয়া কবুলের দৃঢ় আশা নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যাওয়া। 

মোনাজাত শেষে এই দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমার দোয়া শুনেছেন এবং তিনি তা তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী কবুল করবেন। এই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে হবে। দোয়ার ফল নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা অস্থিরতা প্রকাশ করা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।

খ. দোয়া অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করা। 

দোয়া শুধুমাত্র কিছু শব্দ উচ্চারণের নাম নয়, বরং এর সাথে আমলের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, যদি কেউ আল্লাহর কাছে হালাল রিযিকের জন্য দোয়া করে, তবে তাকে হালাল উপার্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। যদি কেউ গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করে, তবে তাকে গুনাহের পথ পরিহার করতে হবে। দোয়া অনুযায়ী নিজের জীবনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলে আল্লাহ সেই দোয়া কবুলের পরিবেশ তৈরি করে দেন।

গ. আল্লাহ যেভাবে ও যখন দোয়া কবুল করেন বা তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করেন, তার উপর সন্তুষ্ট থাকা। (দোয়া কবুলের তিনটি পদ্ধতির হাদিস)। 

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, যখন কোনো মুসলমান এমন কোনো দোয়া করে যাতে কোনো গুনাহের বিষয় বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় না থাকে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে তিনটি পদ্ধতির কোনো একটিতে তার দোয়া কবুল করেন: ১. হয়তো তিনি যা চেয়েছে, তা-ই তাকে দ্রুত দান করেন। ২. অথবা, তিনি তার দোয়ার প্রতিদান আখিরাতের জন্য জমা রাখেন। ৩. অথবা, তিনি তার উপর থেকে সমপরিমাণ কোনো বিপদ বা অকল্যাণ দূর করে দেন। সাহাবায়ে কেরাম এই কথা শুনে বললেন, “তাহলে তো আমরা বেশি বেশি দোয়া করব।” রাসূল (ﷺ) বললেন, “আল্লাহ আরও বেশি দানকারী।” (মুসনাদে আহমাদ)। সুতরাং, আমাদের প্রার্থিত বিষয়টি হুবহু সেভাবে পূরণ না হলেও, আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের জন্য যা করেছেন বা করবেন, তা-ই আমাদের জন্য সর্বোত্তম।

ঘ. দোয়া কবুল না হলেও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে দোয়া চালিয়ে যাওয়া। 

কখনো কখনো বাহ্যিকভাবে দোয়া কবুল হতে বিলম্ব হতে পারে বা মনে হতে পারে যে দোয়া কবুল হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া বা দোয়া করা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। হতে পারে আল্লাহ বান্দার মিনতি আরও শুনতে চান, অথবা এর মাধ্যমে তিনি বান্দার ধৈর্য পরীক্ষা করছেন, অথবা এর বিনিময়ে তিনি আখিরাতে আরও বড় প্রতিদান রেখেছেন। তাই, পূর্ণ আশা ও ইখলাসের সাথে দোয়া চালিয়ে যেতে হবে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

মোনাজাত ও এর দোয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে প্রায়শই কিছু প্রশ্ন জেগে থাকে। এখানে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হলো:

১. মোনাজাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া কোনটি? 

(উত্তর): নির্দিষ্ট কোনো একটি দোয়াকে এককভাবে “শ্রেষ্ঠ” বলা কঠিন, কারণ বিভিন্ন দোয়ার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও ফজিলত রয়েছে। তবে, কোরআনে বর্ণিত “রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আযাবান নার” (সূরা বাকারা: ২০১) দোয়াটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক এবং রাসূল (ﷺ) এটি বেশি পাঠ করতেন। এছাড়াও, সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া। পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী কোরআন-হাদিসের যেকোনো মাসনুন দোয়া বা নিজের ভাষায় আন্তরিক দোয়া সবই আল্লাহর নিকট মূল্যবান।

২. কোরআনের কোন কোন দোয়া মোনাজাতে পড়া যায়? 

(উত্তর): পবিত্র কোরআনে অসংখ্য দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা নবী-রাসূলগণ এবং নেককার বান্দাগণ পাঠ করতেন। যেমন: সূরা ফাতিহা (দোয়ার আকারে), “রাব্বানা যালামনা আনফুসানা…”, দোয়া ইউনুস (“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা…”), “রাব্বি যিদনী ‘ইলমা”, “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা” ইত্যাদি।

৩. হাত তুলে মোনাজাত করার নিয়ম কি?

 (উত্তর): হাত তুলে দোয়া করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ। সাধারণত উভয় হাত বুক বরাবর উঠিয়ে, হাতের তালু আসমানের দিকে রেখে, আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দোয়া করা হয়। তবে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হাত তোলার ধরনে ভিন্নতা দেখা যায়।

৪. ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত কি বিদআত? 

(উত্তর): ফরজ নামাজের পর ইমাম ও মুক্তাদিদের একত্রে হাত তুলে নিয়মিত সম্মিলিত মোনাজাত করা রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল কিনা, এ নিয়ে আলেমগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একদল আলেম এটিকে বিদআত বলেছেন, অন্যরা কিছু শর্তসাপেক্ষে জায়েজ বলেছেন। সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম পন্থা হলো ফরজ নামাজের পর রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত মাসনুন জিকির ও দোয়াগুলো একাকী পাঠ করা। 

৫. নিজের ভাষায় মোনাজাত করা যাবে কি? 

(উত্তর): হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে। যদি আরবি দোয়া মুখস্থ না থাকে বা অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়, তবে নিজের মাতৃভাষায় পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করা জায়েজ এবং আল্লাহ তা কবুল করেন। তবে, মাসনুন দোয়াগুলো শিখে নেওয়ার চেষ্টা করা উত্তম। 

৬. মোনাজাত কবুল হওয়ার লক্ষণ কি? 

(উত্তর): মোনাজাত কবুল হওয়ার কিছু লক্ষণ বান্দা অনুভব করতে পারে, যেমন: অন্তরে প্রশান্তি ও তৃপ্তি লাভ করা, ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া, গুনাহের প্রতি ঘৃণা জন্মানো, আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা, অথবা প্রার্থিত বিষয়টি পূরণ হওয়া বা তার চেয়ে উত্তম কিছু লাভ করা। তবে, বাহ্যিকভাবে কোনো ফল না দেখলেও নিরাশ হওয়া উচিত নয়, কেননা আল্লাহ অন্য কোনো পন্থায়ও দোয়া কবুল করতে পারেন।

৭. মোনাজাতের শুরুতে ও শেষে কী পড়তে হয়? 

(উত্তর): মোনাজাতের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা (হামদ ও সানা) এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করা উচিত। মোনাজাত শেষেও পুনরায় আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শরীফ পাঠ করে “আমীন” বলা মুস্তাহাব।

৮. মৃত ব্যক্তির জন্য মোনাজাতে কী দোয়া পড়ব?

(উত্তর): মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত ও রহমত কামনা করে দোয়া করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। কোরআনিক দোয়া “রাব্বানাগফির লী ওয়া লিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াক্বূমুল হিসাব” অথবা “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা” (পিতামাতার জন্য) পাঠ করা যেতে পারে। এছাড়াও, “আল্লাহুম্মাগফির লাহু ওয়ারহামহু ওয়া ‘আফিহি ওয়া’ফু ‘আনহু…” (জানাজার নামাজের দোয়া) অথবা সাধারণভাবে “হে আল্লাহ, অমুক মৃত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিন, তার কবরকে আলোকিত করুন এবং তাকে জান্নাত নসীব করুন” – এভাবে নিজের ভাষায়ও দোয়া করা যায়।

উপসংহার

মোনাজাত হলো আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ার এক অপূর্ব উপায়, যা মুমিনের ইমানি শক্তি ও আত্মিক শান্তির উৎস। এই প্রবন্ধে আমরা মোনাজাতের দোয়াসমূহ , মোনাজাতের অর্থ, তাৎপর্য, কবুলের শর্ত, আদব, শ্রেষ্ঠ সময় ও স্থান এবং কোরআন-হাদিস থেকে নির্বাচিত দোয়াসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি। এতে প্রতীয়মান হয়, মোনাজাত শুধু দোয়া নয়—এটি আল্লাহর দরবারে সরাসরি আবেদন, কৃতজ্ঞতা ও সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যম।

আমরা যেন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় মোনাজাতের জন্য বরাদ্দ রাখি এবং আল্লাহর কাছে মন খুলে কথা বলি। এটি শুধু দুনিয়ার সমস্যার সমাধান নয়, আখিরাতের সফলতাও নিশ্চিত করতে পারে।সবার প্রতি আহ্বান, আসুন আমরা আন্তরিকতা, বিনয় ও পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করি। কোরআন ও সুন্নাহর দোয়া শিখে মোনাজাতকে জীবনের অংশ বানাই। আল্লাহ আমাদের সকলের দোয়া কবুল করুন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top