অটিজম কি ? অটিজম একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা, যা ব্যক্তির সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং আচরণের উপর প্রভাব ফেলে। Autism Spectrum Disorder (ASD) বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হিসেবে পরিচিত, এটি জন্ম থেকে মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয় এবং প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে প্রতিফলিত হয়।
অটিজম কি ? সহজে বুঝুন
অটিজম একটি ক্রমবর্ধমান বিকাশজনিত অসুবিধা যা সামাজিক যোগাযোগ এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এতে আক্রান্ত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণ সামাজিক নিয়মকানুন বুঝতে এবং তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো প্রকাশে কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারে।
গবেষণার ভিত্তিতে জানা যায় যে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০০০ জনে প্রায় ৬২ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত।
প্রতি বছর অটিজম নিয়ে নানা ধরণের গবেষণা ও পরীক্ষা চালানো হয়, যা থেকে জানা যায় অটিজমের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণ। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে, অটিজম শুধুমাত্র আচরণগত সমস্যা, তবে এটি আরো বিস্তৃতভাবে একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রা এবং দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে পারে।
অটিজমের লক্ষণ ও প্রকারভেদ
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এমন কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে যা প্রত্যেকের জন্য একইভাবে হয় না এবং এই লক্ষণগুলো সাধারণত তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যেতে পারে:
- সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং যোগাযোগে সমস্যা
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামাজিক ইঙ্গিত বুঝতে এবং তাতে সাড়া দিতে প্রায়শই সমস্যায় পড়েন। যেমন:- চোখের যোগাযোগ এড়ানো: অনেক শিশুই চোখের দিকে তাকাতে চায় না বা চোখের মাধ্যমে ইমোশন প্রকাশে অক্ষম থাকে।
- অপরের অনুভূতি বোঝায় অসুবিধা: অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত অপরের অনুভূতির প্রতি কম সংবেদনশীল হয়ে থাকে, ফলে তারা অন্যের ব্যথা বা কষ্ট বুঝতে পারে না।
- ভাষাগত বা কথোপকথনে সমস্যা
অনেক অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ কথোপকথনে অংশগ্রহণ করতে বা সংলাপ বজায় রাখতে সমস্যায় পড়েন। যেমন:- দেরিতে ভাষা বিকাশ: অনেক শিশুই প্রায় নির্দিষ্ট বয়সে কথা বলতে শুরু করে না বা সহজ শব্দ ব্যবহার করতে পারে না।
- পুনরাবৃত্তি করা: বারবার একই শব্দ বা বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তি করে এবং এই আচরণে তারা সান্ত্বনা পায়।
- একঘেয়েমি এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণে অভ্যস্ত। উদাহরণ হিসেবে:- নির্দিষ্ট রুটিন বা অভ্যাস অনুসরণ: তারা একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করতে চায় এবং এতে পরিবর্তন হলে তারা অস্বস্তি অনুভব করে।
- আকর্ষণীয় বস্তুর প্রতি সীমিত মনোযোগ: অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু বা কার্যকলাপে গভীর আগ্রহ দেখায়।
অটিজমের প্রকারভেদ
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে এবং এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। এখানে কিছু সাধারণ প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
- Asperger Syndrome
এই প্রকারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত উচ্চ বুদ্ধিমত্তা এবং ভাষাগত দক্ষতা থাকে, তবে তাদের সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। - Pervasive Developmental Disorder – Not Otherwise Specified (PDD-NOS)
এই ধরনের অটিজমে ব্যক্তির কিছু অটিজম স্পেকট্রাম লক্ষণ দেখা যায় তবে এটি সম্পূর্ণরূপে নির্ধারিত হয় না, ফলে এটি একটি মধ্যবর্তী অবস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। - Classical Autism
এটিই মূলত ঐতিহ্যবাহী অটিজম নামে পরিচিত, যেখানে ভাষাগত চ্যালেঞ্জ, সামাজিক যোগাযোগ সমস্যা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ দেখা যায়।
অটিজমের কারণ: বিজ্ঞান কী বলে?
বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অটিজমের জন্য প্রধানত জেনেটিক এবং পরিবেশগত প্রভাবকে কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অনেক জিনগত পরিবর্তন এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি মস্তিষ্কের বিকাশের উপর প্রভাব ফেলে এবং এটি অটিজমের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
- জেনেটিক কারণ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, অটিজমে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের পরবর্তী প্রজন্মেও এই লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যেসব পরিবারে একাধিক সদস্য অটিজমে আক্রান্ত রয়েছে, তাদের সন্তানদের মধ্যে অটিজম দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বেশি। - পরিবেশগত প্রভাব
অটিজমের জন্য কিছু পরিবেশগত কারণও দায়ী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:- গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্যের অবস্থা: গর্ভাবস্থায় কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন সংক্রমণ বা অপুষ্টি, শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।
- প্রসবকালীন সমস্যা: জন্মের সময় বা এর আগে মস্তিষ্কের কিছু সমস্যা অটিজমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
অটিজম নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
সঠিক তথ্যের অভাবে অনেক সময় অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং সমাজে অটিজম সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়ে গেছে। কিছু ভুল ধারণা হলো:
- অটিজম মানেই বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি: অনেকেই মনে করেন যে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের বুদ্ধিমত্তা কম, তবে এটি সত্য নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন।
- টিকার প্রভাব: টিকার সাথে অটিজমের কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই। এটি একটি মিথ্যা ধারণা যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
অটিজম কি ভাল হয়?
অটিজম কি ভাল হয়? সংক্ষেপে উত্তর হচ্ছে, অটিজম কোনো নিরাময়যোগ্য অসুখ নয়, তবে সঠিক থেরাপি এবং সহায়ক পরিবেশের মাধ্যমে এটি উন্নত করা সম্ভব।
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক কিছু থেরাপি রয়েছে যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে উন্নয়ন আনতে সহায়ক। উল্লেখযোগ্য থেরাপির মধ্যে রয়েছে:
- Applied Behavioral Analysis (ABA): এটি আচরণমূলক থেরাপি যা অটিজম আক্রান্তদের কিছু ইতিবাচক আচরণ শেখাতে সাহায্য করে।
- Speech Therapy: ভাষাগত সমস্যা এবং যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত একটি সাধারণ থেরাপি।
- Occupational Therapy: দৈনন্দিন কাজগুলোতে সহায়ক এই থেরাপিটি অটিজম আক্রান্তদের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নত করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা ও সহায়তা
বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD) আক্রান্ত শিশুদের সঠিক সহযোগিতা দেওয়া এবং সমাজে তাদের মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারী সংস্থা অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য সহায়তা প্রদান করে আসছে।
অটিজম সাপোর্ট সংস্থাগুলোর ভূমিকা
- বাংলাদেশ অটিজম সাপোর্ট ফাউন্ডেশন (BASF): BASF অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের থেরাপি, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ প্রদান করে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আক্রান্তদের মানসিক সহায়তা প্রদান।
- ইন্সটিটিউট অফ নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার্স (INDD): এটি একটি প্রতিষ্ঠান যা গবেষণা এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের উদ্দেশ্য হলো অটিজম আক্রান্তদের জন্য সহায়ক শিক্ষা এবং থেরাপি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
- অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (AWF): এই সংস্থা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং থেরাপি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুদের মানসিক এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ সরকারও বিশেষায়িত স্কুল এবং সহায়তামূলক কার্যক্রম চালু করেছে যাতে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়ক পরামর্শ
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঠিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হলে পরিবারের সদস্য এবং শিক্ষকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনায় নিতে হবে:
- ধৈর্যশীল এবং সহানুভূতিশীল হওয়া: অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়শই অন্যদের মত সাধারণ সামাজিক আচরণে সাড়া দিতে পারে না। তাদের জন্য পরিবারের সদস্যদের ধৈর্য ধরে সহানুভূতিশীল আচরণ করা জরুরি।
- সহজ ভাষায় যোগাযোগ করা: অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত সরাসরি এবং সহজ ভাষা বুঝতে পারেন, তাই তাদের সাথে সহজ ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন।
- প্রতিদিনের রুটিন স্থাপন করা: নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত হলে অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিরাপত্তা এবং সান্ত্বনা অনুভব করে। পরিবারের সদস্যদের উচিত একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করা যাতে তারা আরাম বোধ করে।
- সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা: এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যা তাদের জন্য সহায়ক হয়, যেন তারা সামাজিক এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী হয়।
অটিজম সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন ১: অটিজম কি নিরাময়যোগ্য?
উত্তর: না, অটিজম কোনো নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। তবে, সঠিক থেরাপি এবং সহায়ক পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা সম্ভব।
প্রশ্ন ২: অটিজমের কারণ কী?
উত্তর: গবেষণায় দেখা গেছে যে অটিজমের প্রধান কারণগুলির মধ্যে জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণ রয়েছে। বিশেষ কিছু জিনগত পরিবর্তন এবং প্রসবকালীন সমস্যা এই অবস্থার জন্য দায়ী হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: অটিজম কি পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে?
উত্তর: না, অটিজম সংক্রমণযোগ্য নয়। তবে এটি জেনেটিক কারণে পরিবারের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে, অর্থাৎ একাধিক সদস্যের মধ্যে এর উপস্থিতি দেখা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৪: অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশে অনেক বিশেষ বিদ্যালয় এবং থেরাপি সেন্টার রয়েছে যা অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষার জন্য সহায়ক।
প্রশ্ন ৫: অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য কী ধরনের থেরাপি কার্যকরী?
উত্তর: সাধারণত Applied Behavioral Analysis (ABA), Speech Therapy এবং Occupational Therapy অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সহায়ক হতে পারে। এই থেরাপিগুলো তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন: মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ: কীভাবে মানসিক সমস্যা শরীরের উপর প্রভাব ফেলে
অটিজম কি যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচে মন্তব্য করুন। পোস্টটি যদি তথ্যবহুল মনে হয়, তবে এটি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ!